দুধ পান

যে ৭ কারণে প্রতিদিন দুধ পান করা উচিত

দুধ হচ্ছে স্তন্যপায়ী প্রাণীর স্তন্যগ্রন্থি থেকে উৎপন্ন অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ একটি তরল। যা স্তন্যপায়ী প্রাণীর ভূমিষ্ঠ সন্তানের একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন। এটা ছাড়া মৃত্যু অনিবার্য।

দুধ একটি অদ্ভুত তরল— যা স্তন্যপায়ী প্রাণীর তন্ত্র থেকে নির্গত হয়। সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীর জন্মের পর প্রধান খাদ্য হচ্ছে এই দুধ। প্রতিটা প্রজাতি তার স্বজাতির দুগ্ধ পান করে। কিন্তু একমাত্র মানুষ স্বজাতি ভিন্ন অন্য প্রজাতির প্রাণী দুধ পান করে। যেমন গরু, ছাগল, উট, ভেড়া, দুম্বা, মহিষ।

আজকে ‘যে ৭ কারণে প্রতিদিন দুধ পান করা উচিত’ প্রবন্ধে দুধ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করা হবে। আশা করছি পাঠক মনোযোগ সহকারে এটা পড়বেন।

দুধের আদিম ইতিহাস

স্বাভাবিকভাবে স্তন্যপায়ী প্রাণী তার ভূমিষ্ঠ সন্তানকে দুধ পান করায়। সন্তান জন্ম লাভের পরপর একটি বিশেষ দুধ স্তনে উৎপন্ন হয়। যেটাকে বলা হয় শাল দুধ। এটা খুবই পুষ্টিকর এবং এটাতে রয়েছে অ্যান্টিবডি। যা নবজাতকের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। শুধু মানুষ নয়, বিশ্বের সকল স্তন্যপায়ী প্রাণী এভাবেই তাদের জীবন যাপন করে আসছে সে সৃষ্টি লগ্ন থেকে।

কিন্তু একমাত্র মানুষ এমন একটি প্রাণী যে স্বজাতি ছেড়ে ভিন্ন প্রজাতির প্রাণী দুগ্ধ পান করে। এটা কবে থেকে শুরু হয়েছে তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে অনুমান করা চলে, যেদিন থেকে মানুষ কৃষিকাজ করা শুরু করেছে, হাল চাষের জন্য গবাদি পশু পালন করতে আরম্ভ করেছে, তখন থেকেই বোধ হয় এই দুধ পানের রীতি শুরু হয়েছে।

দুধ এতটাই সুস্বাদু ও জনপ্রিয় যে বিভিন্ন ধর্ম শাস্ত্রে দুধের ব্যবহার উল্লেখ করা হয়েছে।

দুধের পুষ্টিগুণ

জগতের সেরা খাদ্য গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে দুধ। এটাকে সুষম খাদ্যের আধার বিবেচনা করা হয়। সর্বোচ্চ পুষ্টিগুণের জন্যই এই দুধের শ্রেষ্ঠত্ব। দুধের অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে ল্যাকটোজ— যা শরীর গঠন, বিকাশ ও মেধা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

বাংলাদেশের জনগণের সিংহভাগ মানুষ তরল দুধ পান করা থেকে বঞ্চিত। দুধকে আমরা এখনো বিলাসী খাদ্যের তালিকায় বন্দি করে রেখেছি। কিন্তু এটা কোনো বিলাসী খাদ্য নয়। এটা অতীব প্রয়োজনীয় একটি খাদ্য যা মানব দেহের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। ‘যে ৭ কারণে প্রতিদিন দুধ পান করা উচিত’ প্রবন্ধে দুধের পুষ্টিগুণ সমূহ নিচে তুলে ধরা হলো।

গরুর দুধে আছে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, খনিজ পদার্থ যেমন ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, কোবাল্ট, কপার, জিংক, আয়োডিন ও সেলিনিয়াম।

  • গরুর দুধে আছে
  • পানি ৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ
  • ল্যাকটোজ ৪ দশমিক ৮ শতাংশ
  • ফ্যাট ৪ দশমিক ৫ শতাংশ
  • প্রোটিন ৩ দশমিক ৫ শতাংশ
  • ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। গরুর দুধ সব পুষ্টি ও শক্তির উৎস। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ক্যানসার ও হৃদরোগ প্রতিরোধে দুধের শক্তিশালী অবদান প্রমাণিত হয়েছে।

দুধের নানান ব্যবহার

মানুষ শুধু তরল দুধ পান করে এমনটা নয়। মানুষ এই দুধ দিয়ে নানান ধরনের সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্য তৈরি করতে শিখেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দই, পনির, ছানা ইত্যাদি।

এই দইয়ের মধ্যেও আছে বিভিন্ন প্রকারভেদ। টক দই, মিষ্টি দই, আম দই…
পনিরের যে কত প্রকার রয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের পনির তৈরি করা হয়। যেগুলো স্বাদে অনন্য। এছাড়া এ সকল পনিরের দামও অনেক বেশি।

আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে দুধ দিয়ে সাধারণত মাঠা, লাচ্ছি, মিষ্টি, রসমালাই, পিঠা তৈরি করা হয়। এছাড়া চায়ের সাথে দুধের ব্যবহার বলার অপেক্ষা রাখে না।

দুধ উৎপাদন

মানুষ বিভিন্ন প্রাণীর দুধ পান করে। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, উট— তবে সকল প্রাণীর মধ্যে গরুর দুধ বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। এই দুধ সারা বিশ্বে বিপুল পরিমাণে পান করা হয়ে থাকে। এছাড়া এই দুধ থেকে তৈরি বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়।

দুধ উৎপাদন করার ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রথম স্থান অর্জন করেছে নিউজিল্যান্ড। এরপর আছে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ। বিশ্বের সবচাইতে বেশি দুধ আমদানি করে থাকে চীন। তবে ইদানিং তারাও নিজ দেশের চাহিদা পূরণে এগিয়ে গেছে।

বাংলাদেশে দুধের চাহিদার মাত্র ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পূরণ হচ্ছে। ফলে এখনো দুধ রয়ে গেছে পয়সাওয়ালাদের খাদ্যের তালিকায়। কিন্তু এটা যে অতিরিক্ত প্রয়োজনীয় একটি খাদ্য। এটাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক হারে প্রচলিত করতে হলে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে।

আমরা কোথাও কোন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গেলে মিষ্টি অথবা চিপস কিংবা কোমল পানীও নিয়ে যাই। যা মানুষের শরীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এ সকল ক্ষতিকর খাদ্যের বদলে যদি ওই সমপরিমাণ টাকার দুধ কিনে নিয়ে যাওয়া হতো তাহলে অনেক উত্তম হতো।

দুধ পান করার উপকারিতা

দুধ পান করার উপকারিতা

‘যে ৭ কারণে প্রতিদিন দুধ পান করা উচিত’ প্রবন্ধে আমরা দুধের সাতটি গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করেছি। নিচে সেগুলো দেওয়া হলো।

১. দুধে আছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম— যা দাঁত ও হাড়ের গঠন মজবুত করে। দুধে থাকা ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি হাড় ও দাঁতে শোষিত হয়ে এদের গঠন দৃঢ় ও মজবুত করে। প্রত্যহ দুধ পান করলে দাঁত ক্ষয় হয়ে যাওয়া, দাঁতে পোকা ধরা ও হলুদ ছোপ পড়া, হাড় ক্ষয়ের মতো মারাত্মক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

২. রোজ এক গ্লাস দুধ পান করলে অন্যান্য খাবারের চাহিদা অনেকাংশে মিটে যায়। সকাল বেলা দুধ পান করলে সেটা অনেক সময় ধরে পেটে থাকে। ফলে ক্ষুধা কম লাগে।
এছাড়া রোজ দুধ পানের ফলে দেহের অনেক পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয়। তাই ওজন বেড়ে যাওয়া দুধ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। কেননা তখন তৈলাক্ত অথবা অন্যান্য ফ্যাট জাতীয় খাদ্য পরিহার করে দুধের উপর নির্ভর করলে এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে কম সময়ে ওজন কমাতে ও কম রাখা যায়।
এছাড়া দুধে রয়েছে এক অদ্ভুত গুণ। এটা ডিহাইড্রেশন রোধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

৩. দুধে আছে প্রচুর ভিটামিন ও মিনারেল। যা ফিটনেস বাড়ায় ও মানসিক অবসাদ দূর করতে সহায্য করে। দুধ পানে ঘুমের উদ্রেক হয়, যার ফলে মস্তিষ্ক শিথিলতা আসে ও মানসিক চাপ মুক্ত হয়। সারাদিনের মানসিক চাপ দূর করে শান্তির ঘুম নিশ্চিত করতে প্রত্যেক রাতে একটি গ্লাস গরম দুধ পান করা উচিত।

৪. কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা থাকলে দুধ উপশমকারী হিসেবে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। দুধজাতীয় খাবারে অ্যালার্জি না থাকলে রোজ রাতে ঘুমনোর পূর্বে এক গ্লাস গরম দুধ পান করা ভালো।
দুধ কোলেস্টোরল নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং রক্ত পরিষ্কারের পাশাপাশি রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে।

৫. নারীদের মাসিকের সময় বিভিন্ন সমস্যা হয়। সেটা রোধ করতে দুধ অনেক উপকারী। শরীরে ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম সঠিক পরিমাণে না থাকলে প্রি মেনস্ট্রুয়াল সিন্ড্রোম হতে পারে। তাই পিরিয়ডের সময় পেট ব্যথা ও অ্যাসিডিটির সমস্যা হয়। তাই তখন দুধ পান করা উচিত।
দুধে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেল থাকে, যা দেহের ইমিউন সিস্টেম উন্নত করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। প্রতিদিন দুধ পানে ত্বক নরম, কোমল, উজ্জ্বল ও মসৃণ হয়।

৬. প্রোটিনের উৎস হচ্ছে দুধ। দুধে আছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন যা মাংশপেশি তৈরিতে সহায়তা করে ও মাংশপেশির আড়ষ্টতা দূরীকরণে সাহায্য করে। যারা নিয়মিত ব্যায়াম করে তাদের উঠিত প্রতিদিন এক থেকে দুই গ্লাস দুধ পান করা। শিশুদের মাংশপেশির গঠন উন্নত করতেও প্রতিদিন দুধ পান করানো উচিত। অবশ্য লক্ষ্য রাখতে হবে শিশু যাতে দুধ হজম করতে সমস্যা না। যদি শিশুর দুধ হজম করতে সমস্যা হয় তাহলে দুধ না দেওয়াটাই উত্তম।

৭. প্রতিদিন আমরা এমন অনেক ধরণের খাদ্য গ্রহণ করি যা পেটে অ্যাসিডিটি তৈরি করে ও বুক জ্বালাপোড়া করে। এমতাবস্থায় সবচাইতে সহজ সমাধা, প্রতিদিন দুধ পান করা। দুধ পাকস্থলী ঠাণ্ডা রাখে এবং বুক জ্বালাপোড়ার সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

‘যে ৭ কারণে প্রতিদিন দুধ পান করা উচিত’ প্রবন্ধে আপনারা জানতে পেরেছেন দুধ পান করার উপকারিতা।

দুধের অপকারিতা

দুধ অনেক পুষ্টিগণসমৃদ্ধ হলেও এটা অনেকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কাদের জন্য এটা পান করা উচিত নয় সেটা নিজে বলা হলো।

১. যাদের কিডনিতে পাথর হয়েছে তাদের দুধ পান করার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। কিডনি রোগীদের জন্য দুধ কম খাওয়া এবং রাতে দুধ না খাওয়াটাই উত্তম।

২. যাদের শরীরে ‘ল্যাক্টেজ’ (lactase) নামক এনজাইমের অভাব আছে, তাদের উচিত দুধ কম খাওয়া। কেননা এই এনজাইমের অভাবে দুধ হজম হয় না। অবশ্য তারা দুগ্ধ জাত অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য খেতে পারে। যেমন: দই, পনির।

৩. যাদের পেটে অপারেশান করা হয়েছে, তাদের দুধ খাওয়া উচিত নয়। কেননা দুধ অনেক সময় পেটে গ্যাসের সৃষ্টি করতে পারে। ফলে পেটে টান পড়তে পারে। যা অপারেশনের রোগীর জন্য খুবই বিপদজনক।

৪. যদি এলার্জি থাকে, তাহলে দুধ খাওয়ার ব্যাপারে সাবধান হোন। কারণ, এলার্জির রোগীদের দুধ খেতে নিষেধ করেন চিকিৎসকরা। অনেকের আবার দুধ পান করলে এলার্জি বৃদ্ধি পায়।

৫. যাদের পাকস্থলীতে আলসার বা গ্যাস্ট্রিক আলসারের, তাদেরও দুধ খাওয়া উচিত না। এই সকল রোগাক্রান্ত মানুষেরা দুধ খেলে পেট ব্যথা ও ডায়রিয়া হতে পারে।

অতিরিক্ত কোন কিছুই ঠিক না। দুধের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। তবে সকল দিক বিবেচনা করে এটা দেখা যাচ্ছে যে, দুধের ক্ষতিকর দিকের চাইতে উপকারী দিক বেশি। তাই সকলের উচিত যথাসাধ্য পরিমাণে দুধ খাওয়া।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top