শসা আমাদের খুবই পরিচিত একটি ফল বা সবজি। এটাকে ফলের চাইতে সবজি হিসেবে বেশি ব্যবহার করা হয়। এটার একটি বিশেষ গুণ হচ্ছে, এটা সরাসরি কাঁচা অবস্থাতে খাওয়া যায় এবং রান্না করেও খাওয়া যায়। এটা পেকে গেলে এটার মোরব্বা তৈরি করেও সংরক্ষণ করে রাখা যায়। মোটকথা এটা সকল অবস্থাতেই মানুষের খাদ্য উপযোগী।
শসার আদিকাল থেকে ভারতবর্ষে জন্মাচ্ছে। এটা সকল প্রকার মাটিতেই জন্মে থাকে। বেলে মাটি হোক বা দোআঁশ মাটি— উভয় মাটিতেই এর চাষ হয়ে থাকে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে শসা উৎপাদন করা হয়। এর ফলে বিদেশ থেকে শসা আমদানি করতে হয় না। আশা করা যায় খুব দ্রুত বিদেশে রপ্তানি করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। আজকের এই আর্টিকেলে শসার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা হবে। মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য আহ্বান করা হলো।
শসার পুষ্টিমান
প্রতি ১০০ গ্রাম শসার মধ্যে থাকা পুষ্টিমান—
- শক্তি ৬৫ কিলো জুল
- শর্করা ৩.৬৩ g
- চিনি ১.৬৭ g
- খাদ্য আঁশ ০.৫ g
- স্নেহ পদার্থ ০.১১ g
- প্রোটিন ০.৬৫ g
- থায়ামিন (বি১) ০.০২৭ মিগ্রা
- রিবোফ্লাভিন (বি২) ০.০৩৩ মিগ্রা
- নায়াসিন (বি৩) ০.০৯৮ মিগ্রা
- প্যানটোথেনিক অ্যাসিড (বি৫) ০.২৫৯ মিগ্রা
- ভিটামিন বি৬ ০.০৪ মিগ্রা
- ফোলেট (বি৯) ৭ μg
- ভিটামিন সি ২.৮ মিগ্রা
- ভিটামিন কে ১৬.৪ μg
- ক্যালসিয়াম ১৬ মিগ্রা
- লৌহ ০.২৮ মিগ্রা
- ম্যাগনেসিয়াম ১৩ মিগ্রা
- ম্যাঙ্গানিজ ০.০৭৯ মিগ্রা
- ফসফরাস ২৪ মিগ্রা
- পটাশিয়াম ১৪৭ মিগ্রা
- সোডিয়াম ২ মিগ্রা
- জিংক ০.২ মিগ্রা
- পানি ৯৫.২৩ গ্রাম
শসার উপকারিতা
বাংলাদেশের প্রচুর পরিমাণ শশা উৎপাদন করা হয়। শসার মৌসুমে শসার দাম অনেক কমে যায়। এটা খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি রয়েছে এর নানান উপকারিতা। এটা সাধারণত মানুষ সালাদ হিসেবে খায়। অনেকে তরকারি হিসেবেও রান্না করে থাকে। তবে বিশেষজ্ঞগণ বলেন, শসার সালাদ খেলে উপকার বেশি। তাই আজকে শসার উপকারিতা নিয়ে এই আর্টিকেলে কিছু আলোচনা করা হবে।
বিষাক্ততা দূর করে: বিভিন্ন আজেবাজে জাঙ্ক ফুড খাওয়ার জন্য শরীরে অনেক ধরনের টক্সিন তৈরি হয়। বিভিন্ন ময়লা আবর্জনা জমে থাকে। তাই রক্ত পরিশুদ্ধ করতে শসা খাওয়া উচিত। এর মধ্যে থাকা এন্টি অক্সিডেন্ট রক্তের দূষিত পদার্থ দূর করে এবং শরীর রাখে সুস্থ।
আরও পড়ুন: কাঁচা পেঁপের উপকারিতা ও অপকারিতা
ভিটামিনের শূন্যতা পূরণ করে: দৈনিক আমাদের যে সকল ভিটামিন প্রয়োজন তার বেশিরভাগ রয়েছে এই শসাতে। এছাড়া এটাতে আছে বিপুল পরিমাণে খনিজ উপাদান। যা আমাদের শরীর গঠনে সাহায্য করে। তাই নিয়মিত একটি শসা খেতে পারলে দেহের অনেকাংশ ভিটামিন চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
ত্বক সুস্থ রাখতে শসা: শসা যে শুধু মানুষের আভ্যন্তরীণ উপকার করে তা কিন্তু নয়। শসা মানুষের ত্বকের বিভিন্ন উপকার সাধন করে। রূপচর্চায় শসার ব্যবহার হয়ে থাকে। এ সম্পর্কে এই আর্টিকেলের নিচে বিস্তারিত লেখা হয়েছে।
হজম ও ওজন কমাতে শসা: শসা খুব সহজে হজম হয়ে যায়। এছাড়া এটার মধ্যে রয়েছে বিশেষজ্ঞ উপাদান যা খাদ্যটা হজম করতে সাহায্য করে। যাদের খাদ্য হজমে জটিলতা এবং কোষ্ঠকাঠিন্য রয়েছে তারা শশা খেলে উপকার লাভ করতে পারেন। এছাড়া শসায় খুব কম পরিমাণে ক্যালরি রয়েছে। ফলে এটা বেশি পরিমাণে খেলেও ওজন বৃদ্ধি হওয়ার সুযোগ নেই। তাই ক্ষুধা লাগলে কয়েক টুকরো শসা খেলে ক্ষুধা নিবারণ হয়। যাদের ওজন বেশি তারা ওজন কমাতে শসার ব্যবহার করতে পারেন।
মাথা ধরা থেকে নিষ্কৃতি দেয় শসা: খুব সকালবেলা ঘুম থেকে উঠলে মাথা ঝিমঝিম করে। আলস্য সৃষ্টি হয়। এটা সাধারণত ভিটামিনের অভাব এবং কম ঘুমের জন্য হয়ে থাকে। এর জন্য প্রথমত প্রয়োজন দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া। দ্বিতীয়ত ঘুমের আগে কয়েক শসা খেয়ে ঘুমালে মাথা ধরা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।
রূপচর্চায় শসার ব্যবহার
আমরা এতক্ষণ জানলাম শসা মানবদের জন্য কতটা উপকারী। কিন্তু এটা কি শুধু স্বাস্থ্যের উপকার করে? আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন শসা রূপচর্চার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কিভাবে এটার ব্যবহার করতে হয় তা অনেকেই জানেন না। তাই শসা দিয়ে রূপচর্চা করার পদ্ধতি সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো।
জেনে নিন: পান পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা
ডার্ক সার্কেল দূর করতে শসা: অধিক রাত্রে ঘুমানোর ফলে চোখের নিচ কালো হয়ে যায়। এটা দূর করার জন্য প্রথমত প্রয়োজন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাওয়া। কিন্তু তবুও অনেক মানুষের চোখের নিচে কালো দাগ রয়েই যায়। এই দাগ দূর করতে শুধুমাত্র শসা ব্যবহার করলেই চলে। শসা গোলগোল করে কেটে চোখের উপর দিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিলে ভালো উপকার পাওয়া যায়।
এছাড়া শসা কুচকুচ করে কেটে পুরো চোখ জুড়ে অর্থাৎ চোখের নিচে এবং উপরে রেখে দিলে আরো বেশি ফল পাওয়া যায়। তবে এটা নিয়মিত ব্যবহার করতে হবে।
রোদে পোড়া দাগ কমাতে শসা: কর্ম ব্যস্ত জীবনে অনেকের রোদে পুড়ে কাজ করা লাগে। শরীরে অন্যান্য অংশের চাইতে বেশি কোমল ও স্পর্শকাতর হচ্ছে চেহারার ত্বক। এটা রোদে পুড়ে দাগের মতো হয়ে যায়। এমনটা হলে শসার রসের সাথে টক দই ভালোভাবে মিশিয়ে মুখে লাগাতে হবে। এটা সবচাইতে বেশি আরাম দেয় যখন রোদে থেকে ঘরে ফেরা হয়। কেননা তখন ত্বক অনেক বেশি জ্বালাপোড়া করে। এটা ব্যবহার করলে ত্বকের জ্বালাপোড়া কমে যায়।
শুস্ক ত্বকের যত্নে শসা : অনেকের চেহারার ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক। শীতকালে যেমন শরীর ফেটে যায় তেমন চেহারার ত্বক শুষ্ক রুক্ষ রূপ ধারণ করে। এমত অবস্থায় অল্প শসার রসের সাথে দুধের ঘন সর ভালোভাবে মিশ্রণ করতে হবে। সাথে অল্প একটু মধু মিশিয়ে মুখে মাস্কের মতো ব্যবহার করলে খুব দ্রুত রুক্ষ শুষ্কভাব দূর হয়।
এছাড়া আপনি গোসলের পর শসা দিয়ে তৈরি টোনার মুখে মাখতে পারেন। এর জন্য প্রয়োজন শসার রস ও অর্গানিক গোলাপজল। এ দুটো একসাথে মিশিয়ে মুখে মেখে রাখলে মুখ দীর্ঘক্ষণ থাকে আর্দ্র ও কোমল।
তৈলাক্ত ত্বকের মাস্ক: অনেকের মুখের ত্বক অনেক বেশি তৈলাক্ত। সামান্য গরমেই মুখ থেকে ঘামের মতো তেল বের হয়। যা খুবই অস্বস্তিকর। এটা দূর করতে, দুই চামচ শসার রসের সাথে এক চামচ লেবু মিশিয়ে মুখে মাস্কের মতো ব্যবহার করুন। এটাতে সাময়িকভাবে তেল ভাব কম হয়।
ব্রণের ঝামেলা সমাধানে শসা: চেহারা অপরিষ্কার থাকলে অথবা জীবাণুর আক্রমণ ঘটলে ব্রণ হয়। এজন্য উচিত নিয়মিত চেহারা পরিষ্কার করা উচিত।
আরও জেনে নিন: মাশরুম এর উপকারিতা ও অপকারিতা
ছোট্ট একটি বাটিতে তিন টেবিল চামচ শসার রস, এক চামচ লেবুর রস, দুইটা মোট মধু, কয়েক ফোঁটা তুলশীর রস একত্রে মিশিয়ে মুখে ভালোভাবে মাখতে হবে। এরপর এটা শুকিয়ে গেলে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে। এটা বাহির থেকে আসার পর মুখে প্রয়োগ করলে মুখের সকল ধুলি-বালু উঠে যাবে।
বলিরেখা দূর করতে শসা: ত্বকে অনেক সময় অল্প বয়সেই ভাঁজ পড়ে যায়। এগুলোকে বলে বালিরেখা। আপনি খুব সহজেই শসার মাধ্যমে এই বালি রেখা দূর করতে পারেন। দুই চামচ শসার রস, ডিমের সাদা অংশ, এক চামচ লেবুর রস একত্রে মিশিয়ে মুখে মাস্কের মতো ব্যবহার করতে হবে। এটা কিছুটা চিপচিপে ধরনের। একদিন পরপর এটা ১৫ থেকে ২০ মিনিট মুখে লাগিয়ে রাখলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
মাথার যত্নে শসা: অনেকের মাথার তালু অর্থাৎ মাথার ত্বক বড্ড রুক্ষ। ফলে প্রচুর পরিমাণে খুশকি হয়। এমতাবস্থায় শসার রস খুবই উপকারী। শসার রস মাথার ত্বকে লাগিয়ে রেখে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। এরপর ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। এভাবে কিছুদিন করলে ত্বকের রুক্ষ ভাব দূর হবে এবং খুশকির সমস্যা থেকেও পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
শসার অপকারিতা
বাঙালি গরম কাল আসলেই শসা খাওয়া শুরু করে। ভাত খাওয়ার সময় সালাদ হিসাবে। অথবা তরকারি রান্না করেও এটা খায় অনেকে। পথেঘাটে তো লবণ-মরিচ মাখিয়ে বিক্রিও করা হয়। কিন্তু আপনারা হয়তো শসা বেশি পরিমাণে খাওয়ার অপকারিতা সম্পর্কে অবগত নন। মূলত শশা উপকারী একটি ফল কিন্তু অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ক্ষতিকর হতে পারে। আমাদের এই শসা খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা আর্টিকেলে শসা খাওয়ার অপকারিতা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা হলো।
কিডনি রোগীদের জন্য ক্ষতিকর: শসার মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম যা দেহের জন্য খুবই প্রয়োজন। কিন্তু যাদের কিডনিতে সমস্যা রয়েছে, কিডনিতে পাথর— তাদের জন্য বেশি পরিমাণে শসা খাওয়া ক্ষতিকর। এতে করে কিডনির জটিলতা আরো বৃদ্ধি পাবে।
শরীরে জমা হতে পারে ‘টক্সিন’: অত্যন্ত উপকারী ফল। কিন্তু এটার মধ্যে আছে একটি বিশেষ উপাদান— যেটার মাত্রা শরীরে বেশি বৃদ্ধি পেলে শরীরে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। তবে সামান্য পরিমাণে খেলে সমস্যা নেই।
পেটের সমস্যার কারণ: শশা নিঃসন্দেহে খুবই পুষ্টিকর এবং এটা পেট ঠান্ডা রাখে। কিন্তু অধিক পরিমাণে খেলে বদহজম, পেট ফাঁপা, বমি বমি ভাব আসতে পারে।
বারবার প্রস্রাব হতে পারে: শসায় আছে কিউকারবিটিন নামক একটি বিশেষ উপাদান। এই উপাদান মূত্রের মাত্রা বৃদ্ধি করে। আমরা জানি শশা একটি খুবই রসালো সবজি বা ফল। কিন্তু এটা বেশি পরিমাণে খেলে শরীরের সকল পানি মূত্রের মধ্যদিয়ে বয়ে যেতে পারে।