থানকুনি পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা | থানকুনি পাতা ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি সুপরিচিত ঔষধি গাছ। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন ঔষধি ও আয়ুর্বেদিক কর্মকান্ড এই বিশেষ পাতার ব্যবহার হতো। বর্তমান সময়েও আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এর উপকারিতার শেষ নেই। তাই অনেক স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ তাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় থানকুনি পাতা রাখে।
আপনিও এটি ব্যবহারের মাধ্যমে উপকারিতা পেতে পারেন। তবে ব্যবহারের পূর্বেই থানকুনি পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা এবং এর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিতে পারেন এই লেখা থেকে।
থানকুনি পাতার পুষ্টিগুণ
প্রতি ১০০ গ্রাম থানকুনি পাতায় যে সকল পুষ্টি উপাদান থাকে এবং সেগুলোর পরিমাণ নিচে তুলে ধরা হলো:
- ক্যালোরি: ৩৮ কিলোক্যালোরি
- প্রোটিন: ২.৬ গ্রাম
- ফ্যাট: ০.৫ গ্রাম
- কার্বোহাইড্রেট: ৭.৪ গ্রাম
- ফাইবার: ৩.৫ গ্রাম
- ভিটামিন এ: ৬৫৪০ IU
- ভিটামিন সি: ৪৮ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি১ (থিয়ামিন): ০.১৫ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি২ (রিবোফ্লাভিন): ০.১৯ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি৩ (নায়াসিন): ০.৬ মিলিগ্রাম
- ক্যালসিয়াম: ১৭১ মিলিগ্রাম
- আয়রন: ৫.৬ মিলিগ্রাম
- পটাসিয়াম: ৩৪৪ মিলিগ্রাম
- ম্যাগনেসিয়াম: ৬০ মিলিগ্রাম
- ফসফরাস: ৫৬ মিলিগ্রাম
- সোডিয়াম: ৪৩ মিলিগ্রাম
- জিঙ্ক: ০.৮ মিলিগ্রাম
- কপার: ০.১৬ মিলিগ্রাম
- ম্যাঙ্গানিজ ০.৭৬ মিলিগ্রাম
এই পুষ্টি উপাদানগুলো থাকার কারনে, থানকুনি পাতা একটি অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর খাদ্য উপাদান হিসেবে পরিনত হয়েছে।
আরও পড়ুন: রসুনের স্বাস্থ্য উপকারিতা ও অপকারিতা কি জেনে নিন
থানকুনি পাতার উপকারিতা
প্রাচীনকাল থেকেই থানকুনি পাতা তার বহুবিধ উপকারিতার জন্য আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমান সময়েও এর ব্যবহার কমেনি। থানকুনি পাতার প্রধান উপকারিতাগুলো হলো:
(১) মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়
থানকুনি পাতার অন্যতম প্রধান উপকারিতা হলো এটি মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। এটি মস্তিষ্কের স্নায়ুর সংযোগ স্থাপন করে এবং স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, থানকুনি পাতা উদ্বেগ ও হতাশা কমাতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
মূলত এটি নিউরোট্রান্সমিটার উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। যা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
(২) ক্ষত নিরাময়ে সহায়তা করে
থানকুনি পাতা প্রাকৃতিকভাবে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্যযুক্ত। এটি দ্রুত ক্ষত নিরাময়ে সহায়ক। থানকুনি পাতার নির্যাস বা পেস্ট ক্ষতস্থানে প্রয়োগ করলে এটি ত্বকের কোষ পুনর্জন্মে সহায়তা করে এবং ক্ষত দ্রুত শুকাতে সাহায্য করে।
(৩) হজমশক্তি বৃদ্ধি করে
থানকুনি পাতা হজমশক্তি বাড়াতে অত্যন্ত কার্যকর। এটি গ্যাস্ট্রিক আলসার, অম্লতা এবং কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে সহায়তা করে। থানকুনি পাতার রস বা নির্যাস গ্রহণ করলে হজম শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং পেটের নানা সমস্যার সমাধান হয়।
(৪) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
থানকুনি পাতায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এটি শরীরকে বিভিন্ন ইনফেকশন থেকে রক্ষা করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। নিয়মিত থানকুনি পাতা সেবন করলে শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা মজবুত হয়।
(৫) ত্বকের যত্নে উপকারি
থানকুনি পাতা ত্বকের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে ব্যবহৃত হয়। এটি ব্রণ, ত্বকের দাগ, ফুসকুড়ি এবং শুষ্ক ত্বক নিরাময়ে সহায়তা করে। থানকুনি পাতার পেস্ট ত্বকে প্রয়োগ করলে এটি ত্বক মসৃণ ও উজ্জ্বল করে তোলে। এছাড়াও থানকুনি পাতা ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে, যা ত্বককে সুস্থ ও সতেজ রাখে। জেনে নিন- আখরোট এর উপকারিতা ও অপকারিতা
(৬) বাত এবং আর্থ্রাইটিসের ব্যাথা কমায়
থানকুনি পাতা বাত এবং আর্থ্রাইটিসের ব্যথা কমাতে সহায়ক। এর অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য বাত এবং আর্থ্রাইটিসের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। থানকুনি পাতার নির্যাস বা তেল আক্রান্ত স্থানে প্রয়োগ করলে ব্যথা কমে যায়।
(৭) রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধিতে সহায়ক
থানকুনি পাতা রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধিতে সহায়ক। এটি রক্তনালীগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্ত সঞ্চালন নিশ্চিত করে। এর ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং শরীর সুস্থ থাকে।
(৮) ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে
থানকুনি পাতা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করে। এটি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং ইনসুলিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। নিয়মিত থানকুনি পাতা সেবনে ডায়াবেটিস রোগীরা উপকৃত হয়।
থানকুনি পাতার বহুমুখী উপকারিতা এবং স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে এর ব্যবহার অত্যন্ত কার্যকর। সার্বিকভাবে থানকুনি পাতা একটি মূল্যবান ঔষধি গাছ, যা নিয়মিত ব্যবহার করা উচিত।
যৌবন ধরে রাখতে থানকুনি পাতার উপকারিতা
থানকুনি পাতা যৌবন ধরে রাখতে অত্যন্ত কার্যকরী। নিয়মিত থানকুনি পাতা সেবন করলে, পুরুষ এবং নারী উভয়েরই যৌন স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে। এছাড়া এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান ত্বককে মুক্ত র্যাডিকেল থেকে রক্ষা করে, যা বার্ধক্যের লক্ষণ কমাতে সাহায্য করে।
থানকুনি পাতা ত্বকের কোলাজেন উৎপাদন বাড়ায়, ফলে ত্বক টানটান ও মসৃণ থাকে। এছাড়া, এটি রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে, যা ত্বকের স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। থানকুনি পাতা ত্বকের দাগ, ব্রণ এবং ফুসকুড়ি নিরাময়ে সহায়ক, ফলে ত্বক উজ্জ্বল ও সুন্দর থাকে।
তাই থানকুনি পাতা নিয়মিত ব্যবহারে ত্বক ও চুল সুস্থ ও প্রাণবন্ত থাকে, যা যৌবন ধরে রাখতে সাহায্য করে।
পেটের সমস্যায় থানকুনি পাতা
পেটের সমস্যায় থানকুনি পাতা অত্যন্ত কার্যকর। থানকুনি পাতা হজমশক্তি বাড়ায় এবং গ্যাস্ট্রিক, অম্লতা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। থানকুনি পাতার রস বা নির্যাস খেলে পেটের গ্যাস ও অম্লতা কমে যায় এবং হজমের সমস্যা সমাধান হয়।
প্রতিদিন সকালে খালি পেটে থানকুনি পাতার রস ১-২ চামচ খেলে পেটের সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে। এছাড়া থানকুনি পাতা পানিতে সেদ্ধ করে সেই পানি পান করলেও পেটের সমস্যার সমাধান হয়। থানকুনি পাতার পাউডারও গরম পানির সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন।
চুলের জন্য থানকুনি পাতার উপকারিতা
থানকুনি পাতা চুলের যত্নে অত্যন্ত কার্যকর। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান চুলের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। থানকুনি পাতা চুলের গোড়া মজবুত করে এবং চুল পড়া কমায়। এটিও পড়তে পারেন- ড্রাগন ফলের উপকারিতা ও অপকারিতা
চুলের জন্য থানকুনি পাতা নিম্নোক্তভাবে ব্যবহার করতে পারেন:
- থানকুনি পাতার রস মাথার ত্বকে প্রয়োগ করলে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। এতে চুলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।
- থানকুনি পাতা পেস্ট করে চুলের গোড়ায় মেখে, ৩০ মিনিট রেখে শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এতে খুশকি ও মাথার ত্বকের শুষ্কতা কমে।
এভাবে নিয়মিত থানকুনি পাতা ব্যবহারে চুলের উজ্জ্বলতা বাড়বে এবং চুল হবে সুস্থ ও সুন্দর।
থানকুনি পাতা খাওয়ার নিয়ম
থানকুনি পাতা খাওয়ার কয়েকটি কার্যকর নিয়ম রয়েছে। থানকুনি পাতা পেস্ট করে রস বের করে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ১-২ চামচ খেতে পারেন। এতে হজমশক্তি বাড়বে এবং পেটের সমস্যা কমবে। আবার, তাজা থানকুনি পাতা সালাদে মিশিয়ে খেতে পারেন। এটি পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
এছাড়া থানকুনি পাতা ফুটিয়ে চা বানিয়ে পান করা করতে পারেন। এটি মানসিক চাপ কমায় এবং শরীরকে সতেজ রাখে। থানকুনি পাতা ভর্তা করে খাওয়া যায়, যা খাবারের স্বাদ ও পুষ্টি বাড়ায়। এই নিয়মগুলো মেনে চললে থানকুনি পাতা থেকে সর্বাধিক উপকারিতা পাওয়া সম্ভব।
থানকুনি পাতার অপকারিতা
থানকুনি পাতা সাধারণত স্বাস্থ্যকর হলেও অতিরিক্ত বা দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে কিছু ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। এর ক্ষতিকর দিকগুলো হলো:
- অতিরিক্ত থানকুনি পাতা খেলে পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া, এবং বমি হতে পারে।
- দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে লিভারের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
- কিছু লোকের ক্ষেত্রে ত্বকে র্যাশ বা অ্যালার্জি হতে পারে।
- উচ্চ মাত্রায় থানকুনি পাতা খেলে রক্তচাপ কমে যেতে পারে, যা নিম্ন রক্তচাপের রোগীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
- গর্ভবতী মহিলাদের থানকুনি পাতা খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এটি গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
শেষকথা
উপরোক্ত আলোচনা থেকে থানকুনি পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলেন। থানকুনি পাতা সঠিক মাত্রায় ও উপায়ে খেলে উপকারিতা পাওয়া যায়, তবে অতিরিক্ত বা অসতর্ক ব্যবহারে এই ক্ষতিকর দিকগুলো দেখা দিতে পারে। তাই সতর্কতার সাথে ব্যবহার করুন।