অশ্বগন্ধার উপকারিতা ও অপকারিতা | অশ্বগন্ধা একটি প্রাচীন ঔষধি উদ্ভিদ, যা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বহুল ব্যবহৃত হয়। এর মূল এবং পাতা থেকে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়, যা মানবদেহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আপনিও হয়তো স্বাস্থ্যের উপকারিতা পেতে অশ্বগন্ধা সেবন করতে চাচ্ছেন। তাই ব্যবহারের আগেই অশ্বগন্ধার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন এখানে।
অশ্বগন্ধায় থাকা পুষ্টি উপাদানের তালিকা
প্রতি ১০০ গ্রাম অশ্বগন্ধা মূলের মধ্যে সাধারণত যে পুষ্টি উপাদান গুলো পাওয়া যায়, সেগুলোর পরিমাণ সহ নিচে তুলে ধরা হলো:
- ক্যালরি: ২৪৫ ক্যালরি
- প্রোটিন: ৩.৯ গ্রাম
- ফ্যাট: ০.৩ গ্রাম
- কার্বোহাইড্রেট: ৩২ গ্রাম
- ডায়েটারি ফাইবার: ১৩ গ্রাম
- ভিটামিন সি: ৩.৭ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন এ: ২.০ আইইউ (IU)
- ক্যালসিয়াম: ২৩ মিলিগ্রাম
- আয়রন: ৩.৩ মিলিগ্রাম
- পটাশিয়াম: ৪৫৩ মিলিগ্রাম
- ম্যাগনেসিয়াম: ৫০ মিলিগ্রাম
- ফসফরাস: ৭৮ মিলিগ্রাম
- সোডিয়াম: ৫.৪ মিলিগ্রাম
- এছাড়াও যথেষ্ট পরিমাণে ফ্ল্যাভোনয়েডস এবং ফেনোলিক অ্যাসিডস নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে।
অশ্বগন্ধার উপকারিতা | অশ্বগন্ধা খাওয়ার উপকারিতা
অশ্বগন্ধা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে বহুল ব্যবহৃত একটি প্রাচীন ঔষধি উদ্ভিদ। ভারতীয় উপমহাদেশে এর ব্যবহার হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রচলিত। আধুনিক বিজ্ঞানও এর উপকারিতার স্বীকৃতি দিয়েছে। নিচে অশ্বগন্ধার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:
(১) মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ কমায়
অশ্বগন্ধা প্রাকৃতিকভাবে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। এটি মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমাতে সহায়ক। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, অশ্বগন্ধা মানসিক চাপের মাত্রা কমিয়ে এবং কর্টিসল হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
আরও পড়ুন: সজনে পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা
(২) দৈহিক শক্তি বাড়ায়
অশ্বগন্ধা শারীরিক শক্তি এবং স্ট্যামিনা বৃদ্ধিতে সহায়ক। এটি শারীরিক পরিশ্রমের সময় সহনশীলতা বাড়ায় এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত অশ্বগন্ধা সেবন করলে ক্লান্তি দূর হয় এবং দৈহিক সামর্থ্য বৃদ্ধি পায়।
(৩) ইমিউনিটি সিস্টেম শক্তিশালী করে
অশ্বগন্ধা আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। নিয়মিত এটি সেবন করলে বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে দেহকে সুরক্ষিত রাখে। এটি লিউকোসাইট এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষা কোষের কার্যক্ষমতাও বাড়ায়। ফলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
(৪) হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক
অশ্বগন্ধা হৃদপিণ্ডের সুস্থতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অশ্বগন্ধা সেবনে রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে।
(৫) রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ
অশ্বগন্ধা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। এটি ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বাড়ায় এবং গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল থাকে। ড্রাগন ফলের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ুন।
(৬) হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা
অশ্বগন্ধা হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক এবং মহিলাদের মাসিক চক্র নিয়মিত রাখতেও সাহায্য করে। এছাড়াও এটি পুরুষদের টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি করে।
(৭) মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি
অশ্বগন্ধা স্মৃতিশক্তি এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতেও উপকারী প্রভাব ফেলে। এটি নিউরন সেল রিজেনারেশন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। ফলে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্থ কোষ পুনরুদ্ধার হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, অশ্বগন্ধা সেবনে শিক্ষাগত দক্ষতা এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।
(৮) ঘুমের মান উন্নত করে
অশ্বগন্ধা ঘুমের মান উন্নত করতে সাহায্য করে। এটি প্রাকৃতিক সেডেটিভ হিসেবে কাজ করে এবং মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধি করে। ফলে ঘুমের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। নিয়মিত অশ্বগন্ধা সেবনে নিদ্রাহীনতা দূর হয় এবং ঘুমের সমস্যার সমাধান হয়।
অশ্বগন্ধার এই বহুমুখী উপকারিতাগুলো এটিকে একটি অত্যন্ত মূল্যবান ঔষধি উদ্ভিদ হিসেবে পরিগণিত করেছে। আধুনিক জীবনের নানা সমস্যার সমাধানেও প্রাচীন এই আয়ুর্বেদিক ঔষধের ব্যবহার পুনরায় গুরুত্ব পাচ্ছে প্রায় সর্বত্রই।
ছেলেদের জন্য অশ্বগন্ধার উপকারিতা
ছেলেদের জন্য অশ্বগন্ধার বিশেষ কিছু উপকারিতা রয়েছে। যেমন:
- শারীরিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি: অশ্বগন্ধা পুরুষের শারীরিক স্ট্যামিনা এবং শক্তি বৃদ্ধিতে কার্যকরী। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত অশ্বগন্ধা সেবনে পেশীর ভর এবং শক্তি বৃদ্ধি পায়, যা একটি ছেলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি: ছেলেদের স্বাভাবিক টেস্টোস্টেরন মাত্রা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অশ্বগন্ধা প্রাকৃতিকভাবে টেস্টোস্টেরন বৃদ্ধি করে। যা একইসাথে যৌন স্বাস্থ্যের উন্নতি, শুক্রাণুর গুণগত মান বৃদ্ধি এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়ক।
- স্ট্রেস এবং উদ্বেগ কমায়: আধুনিক জীবনের নানান উদ্বেগ আমাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অশ্বগন্ধার অ্যাডাপ্টোজেনিক বৈশিষ্ট্য স্ট্রেস এবং উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে। এটি ছেলেদের শরীরে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে মানসিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখে।
- ঘুম ভালো হয়: সুস্বাস্থ্যের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম অপরিহার্য। অশ্বগন্ধার সেডেটিভ গুণাবলী গভীর এবং শান্তিপূর্ণ ঘুম আনতে সাহায্য করে। এটিও পুরুষের শারীরিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতেও সহায়ক।
- হৃদরোগ প্রতিরোধ: অশ্বগন্ধা কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে। এটি বয়স্ক পুরুষদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী।
দৈনন্দিন জীবনে অশ্বগন্ধা অন্তর্ভুক্ত করলে, ছেলেদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব।
মেয়েদের জন্য অশ্বগন্ধার উপকারিতা
মেয়েদের জন্য অশ্বগন্ধার বিশেষ কিছু উপকারিতা রয়েছে। যেমন:
- হরমোনের ভারসাম্য: অশ্বগন্ধা নারীদের হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক। এটি মাসিক চক্র নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করে, ফলে পিএমএস এবং মেনোপজের লক্ষণগুলো কমিয়ে দেয়। পাশাপাশি এটি আবেগজনিত স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করে।
- মানসিক চাপ কমায়: দীর্ঘস্থায়ী চাপ নারীদের উপর উল্লেখযোগ্য ভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যা বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অশ্বগন্ধা একটি অ্যাডাপ্টোজেন হিসেবে কাজ করে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা কমায় এবং মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধি করে।
- জীবনীশক্তি বৃদ্ধি করে: নারীরা প্রায়ই একাধিক দায়িত্ব পালন করে। যার ফলে ক্লান্তি বোধ হয় এবং শক্তি হ্রাস পায়। অশ্বগন্ধা শারীরিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ক্লান্তি কমায়।
- ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো রাখে: অশ্বগন্ধার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণাবলী অক্সিডেটিভ স্ট্রেস প্রতিরক্ষা করে। যা ত্বকের বয়স বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ। অশ্বগন্ধার ত্বকের রং, স্থিতিস্থাপকতা এবং আর্দ্রতা উন্নত করে, ফলে ত্বক আরও উজ্জ্বল দেখায়।
- যৌন ইচ্ছা বৃদ্ধি করে: যেসকল নারীরা যৌন ইচ্ছার হ্রাসের সম্মুখীন হয়, তাদের জন্য অশ্বগন্ধা অত্যন্ত উপকারী।
- হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখে: অশ্বগন্ধা হাড় গঠনের কোষগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধি করে। এটি নারীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাদের অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বেশি। নারীদের দেহে এটি হাড়ের ঘনত্ব এবং শক্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
অশ্বগন্ধা কিভাবে খাবেন | অশ্বগন্ধা খাওয়ার নিয়ম
অশ্বগন্ধা বিভিন্নভাবে খাওয়া যেতে পারে। যেমন: পাউডার, ক্যাপসুল বা তরল নির্যাস হিসেবে। সাধারণ মানুষ সহজে যেভাবে অশ্বগন্ধা খেতে পারেন, তার নিয়ম নিচে দেওয়া হলো:
পাউডার আকারে
প্রতিদিন ১-২ চা চামচ অশ্বগন্ধা গরম দুধ, পানি, বা মধুর সাথে মিশিয়ে খান। রাতে ভাল ঘুমের জন্য বা সকালে শক্তি বৃদ্ধির জন্য খেতে পারেন।
ক্যাপসুল আকারে
প্রতিদিন ১-২টি অশ্বগন্ধার ক্যাপসুল খেতে পারেন। এক্ষেত্রে খাবারের পর পানি দিয়ে গিলে ফেলুন। নিয়মিত সকালে এবং সন্ধ্যায় খেলে ভালো উপকারিতা পাবেন। আখরোট এর উপকারিতা ও অপকারিতা বিস্তারিত তথ্য জেনে নিন।
তরল আকারে
প্রতিদিন ১-২ চা চামচ পরিমানে অশ্বগন্ধার মূলের নির্যাস খেতে পারেন। অথবা এটি ঔষধের কৌটায়ও সিরাপ আকারে কিনতে পাওয়া যায়। আপনি চাইলে পানি বা জুসের সাথে মিশিয়ে এটি নিয়মিত খেতে পারেন।
তবে অশ্বগন্ধা খাওয়ার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। প্রথম দিকে অল্প পরিমাণে খেতে হবে। নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসার জন্য খেলে, অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
অশ্বগন্ধার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া | অশ্বগন্ধার অপকারিতা
অশ্বগন্ধা সাধারণত নিরাপদ হলেও, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এটি অতিরিক্ত সেবনে পেট খারাপ, ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব, এবং অম্লতার সৃষ্টি হয়। কিছু মানুষের দেহে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া, যেমন- চুলকানি বা ফুসকুড়ি অনুভব করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী বা উচ্চ মাত্রায় সেবন করলে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা পরিবর্তন হতে থাকে।
গর্ভবতী এবং স্তন্যদানকারী মহিলাদের অশ্বগন্ধা এড়ানো উচিত। কারণ এটি গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া অশ্বগন্ধা কিছু ঔষধের সাথে বিরূপ প্রতিক্রিয়া করতে পারে। তাই যারা নিয়মিত বিভিন্ন প্রকারের ওষুধ সাধন করে থাকে, তারা অশ্বগন্ধা খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
শেষকথা
এই ছিল আশ্বগন্ধার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে আজকের বিস্তারিত আলোচনা। ধন্যবাদ।