কাঠ বাদাম এর উপকারিতা ও অপকারিতা | কাঠ বাদাম একটি উচ্চ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার যা হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক এবং হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। বাংলাদেশের জনসাধারণের মাঝে দৈনন্দিন খাদ্য তালিকা এটি অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও, স্বাস্থ্য সচেতনরা এটি নিয়মিতই খেয়ে থাকে।
মানবদেশের জন্য এর বেশকিছু উপকারিতা ও নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। তাই খাওয়ার পূর্বেই আপনার দেহের জন্য কাঠ বাদাম এর উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন এখানে।
কাঠ বাদাম এর পুষ্টিগুণ
প্রতি ১০০ গ্রাম কাঠ বাদামে যেসকল পুষ্টিগুণ থাকে সেগুলোর পরিমাণ সহ নিচে তুলে ধরা হলো:
- শক্তি: ৫৭৯ ক্যালোরি
- প্রোটিন: ২১.২ গ্রাম
- মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট: ৩১.৬ গ্রাম
- পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট: ১২.২ গ্রাম
- স্যাচুরেটেড ফ্যাট: ৩.৮ গ্রাম
- কার্বোহাইড্রেট: ২১.৬ গ্রাম
- ডায়েটারি ফাইবার: ১২.৫ গ্রাম
- চিনির পরিমাণ: ৪.৪ গ্রাম
- ভিটামিন ই: ২৫.৬ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি২ (রিবোফ্লাভিন): ১.০১ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি৩ (নিয়াসিন): ৩.৩৮ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি৯ (ফোলেট): ৪৪ মাইক্রোগ্রাম
- ক্যালসিয়াম: ২৬৯ মিলিগ্রাম
- আয়রন: ৩.৭১ মিলিগ্রাম
- ম্যাগনেসিয়াম: ২৭০ মিলিগ্রাম
- ফসফরাস: ৪৮১ মিলিগ্রাম
- পটাসিয়াম: ৭৩৩ মিলিগ্রাম
- জিঙ্ক: ৩.১২ মিলিগ্রাম
কাঠ বাদাম এর উপকারিতা
কাঠ বাদাম একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর খাবার। এটি স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিদের খাদ্যতালিকায় নিয়মিতভাবেই স্থান পায়। এটি শুধু স্বাদেই অতুলনীয় নয়, বরং পুষ্টিগুণেও ভরপুর। কাঠ বাদামে প্রোটিন, স্বাস্থ্যকর চর্বি, ফাইবার, ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থের মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান রয়েছে, যা শরীরের সার্বিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে সহায়ক। কাঠবাদাম খাওয়ার মাধ্যমে আমরা যেসকল উপকারিতা গুলো পেতে পারি, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিচে তুলে ধরা হলো:
(১) হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখে
আমন্ডের অন্যতম প্রধান উপকারিতা হলো এটি হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষায় অত্যন্ত কার্যকর। এতে থাকা মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ও পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত কাঠ বাদাম খেলে রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমে যায়, যা হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমিয়ে আনে।
আরও পড়ুন: আখরোট এর উপকারিতা ও অপকারিতা
এছাড়া কাঠ বাদামে থাকা ভিটামিন ই এবং ফ্ল্যাভোনয়েড অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রক্তনালীগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
(২) রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে
কাঠ বাদামে উচ্চ মাত্রায় ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। ম্যাগনেসিয়ামের অভাব উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম প্রধান কারণ। এর ফলে হার্টের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় কাঠ বাদাম অন্তর্ভুক্ত করলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়।
(৩) রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখে
কাঠ বাদামে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কম, কিন্তু প্রোটিন এবং ফাইবারের পরিমাণ বেশি। এই গুণাবলী রক্তের শর্করার স্তর স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কাঠ বাদাম খেলে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের রোগীদের রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয় এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত হয়।
(৪) ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে
প্রোটিন এবং ফাইবার সমৃদ্ধ কাঠ বাদাম ক্ষুধা কমাতে সহায়ক। ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়। এটি একটি পরিপূর্ণ গুণাগুণ সম্পন্ন স্ন্যাক্স, যা খিদে মেটাতে সাহায্য করে এবং অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ এড়াতেও সহায়ক। এছাড়া কাঠ বাদামে থাকা স্বাস্থ্যকর চর্বি শরীরের বিপাক ক্রিয়া উন্নত করে, যা ওজন হ্রাসে সহায়ক।
(৫) হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে
কাঠ বাদামের উচ্চ ফাইবার উপাদান হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে। এতে থাকা ফাইবার অন্ত্রের গতিশীলতা বৃদ্ধি করে এবং পরিপাকতন্ত্রের কার্যকারিতা উন্নত করে।
জেনে নিন: চা সম্পর্কে অজানা কিছু তথ্য
(৬) ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে
ভিটামিন ই এবং অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উপস্থিতির কারণে কাঠ বাদাম ত্বকের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি ত্বককে ফ্রি র্যাডিক্যালের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে, যা বার্ধক্যজনিত লক্ষণ কমাতে সাহায্য করে। নিয়মিত কাঠ বাদাম খেলে ত্বক উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যকর থাকে। তাই বাংলাদেশের বহু মধ্য বয়সে নারীরা তাদের ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে কাঠ বাদাম খাওয়ার পাশাপাশি রূপচর্চায় ব্যবহার করে।
(৭) হাড়ের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে
কাঠ বাদামে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ফসফরাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদানগুলো রয়েছে। এগুলো হাড়ের গঠন ও শক্তি বজায় রাখতে সহায়ক। এটি অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকি কমাতে পারে এবং হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
(৮) মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে
ভিটামিন বি২ এবং এল-কার্নিটাইন সমৃদ্ধ কাঠ বাদাম মস্তিষ্কের কার্যকারিতা আরো উন্নততর করতে সহায়ক। এটি স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে এবং আলঝেইমার রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। নিয়মিত কাঠ বাদাম খেলে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে এবং মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে। তাই স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির জন্য, মধ্যবয়সী থেকে বৃদ্ধদের মাঝে নিয়মিত কাঠ বাদাম খাবার প্রচলন লক্ষ করা যায়।
উপরোক্তভাবে আমরা কাঠবাদাম খেয়ে উপকারিতা পেতে পারি। তবে এটি খুব বেশি খেলে অতিরিক্ত ক্যালোরি শরীরে প্রবেশ করবে। তাই প্রতিদিনের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।
কাঠ বাদাম ভিজিয়ে খাওয়ার উপকারিতা
কাঠ বাদাম ভিজিয়ে খাওয়ার উপকারিতা অনেক। ভিজিয়ে কাঠ বাদাম খেলে, তা সহজপাচ্য এবং পুষ্টি উপাদান শোষণে সহায়ক হয়। ভিজানোর ফলে এই বাদামে থাকা ফাইটিক অ্যাসিড কমে যায়। এতে ভিটামিন বি, বিশেষ করে ভিটামিন বি১২ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা- প্রেগন্যান্সি খাদ্য তালিকা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন।
ভিজানো বাদাম হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা, ওজন নিয়ন্ত্রণ, ত্বকের উন্নতি এবং শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া এটি হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে এবং শরীরকে সারাদিন সক্রিয় রাখে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার জন্য প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ভিজানো কাঠ বাদাম অন্তর্ভুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।
কাঠ বাদাম খাওয়ার নিয়ম
কাঠ বাদাম খাওয়ার সঠিক নিয়ম মানলে এর পুষ্টিগুণ এবং উপকারিতা সর্বাধিক উপভোগ করা সম্ভব। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ৮-১০টি কাঠ বাদাম ভিজিয়ে খাওয়া সবচেয়ে উপকারী। ভিজানোর জন্য বাদামগুলো সারারাত পানিতে ভিজিয়ে রাখুন এবং সকালে সেগুলোর ছাল ছাড়িয়ে খেয়ে নিন।
ভিজিয়ে খেলে বাদাম সহজপাচ্য হয় এবং পুষ্টি উপাদান শোষণ বৃদ্ধি পায়। দিনে দুইবারের বেশি বাদাম না খাওয়াই উত্তম। কারণ এতে ক্যালোরি বেশি থাকে যা অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
যাদের বাদামজাতীয় খাবারে অ্যালার্জি রয়েছে তাদের বাদাম খাওয়া এড়ানো উচিত। এছাড়া যাদের কিডনির সমস্যা বা উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, তাদেরকেও চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বাদাম খাওয়া উচিত। বাদামকে একটি স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস হিসেবে বিবেচনা করে পরিমিত পরিমাণে খেলে এর পুষ্টিগুণ এবং স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করা সম্ভব।
কাঠ বাদামের ক্ষতিকর দিক
যদিও কাঠ বাদাম পুষ্টিকর, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এর ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। অতিরিক্ত কাঠ বাদাম খেলে:
- ওজন বেড়ে যেতে পারে, কারণ এতে উচ্চ পরিমাণে ক্যালোরি এবং চর্বি থাকে।
- কাঠ বাদামে অক্সালেট থাকে, যা কিডনির পাথরও তৈরি করতে পারে।
- যারা বাদামে অ্যালার্জি আছে, তাদের জন্য কাঠ বাদাম খাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে। কারণ এর ফলে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া, যেমন- চুলকানি, ফুসকুড়ি, এবং শ্বাসকষ্টের সমস্যা তৈরি হয়।
- কাঠ বাদামে ফাইটিক অ্যাসিড রয়েছে, যা দেহে মিনারেল শোষণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
- উচ্চ রক্তচাপ বা কিডনির সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া বাদাম খাওয়া উচিত নয়। একারণে
এছাড়াও কাঠ বাদাম খাওয়ার আগে পরিমাণ এবং নিজের স্বাস্থ্যের অবস্থা বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পরিমিত পরিমাণে কাঠ বাদাম অন্তর্ভুক্ত করা উত্তম। তাহলেই এর পুষ্টিগুণ গুলো উপভোগ করা যাবে এবং ক্ষতিকর দিকগুলো এড়ানো যাবে।
কাঠ বাদাম এর দাম
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতি কেজি কাঠ বাদাম ৯০০-১৫০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এটি মূলত নির্ভর করে কাঠ বাদামের কোয়ালিটির উপর এবং আপনি কোথা থেকে সংগ্রহ করছেন তার উপর। সাধারণত আমরা স্থানীয় বড় মুদি দোকানগুলো থেকে কিংবা অনলাইন শপ থেকে কাঠবাদাম ক্রয় করতে পারি।
শেষকথা
কাঠ বাদাম এর উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে এই ছিল আজকের বিস্তারিত আলোচনা। ধন্যবাদ।