আনারসের উপকারিতা ও অপকারিতা | আনারস একটি অত্যন্ত সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর ফল। মৌসুমী এই ফলটি আমাদের দেহের জন্য ব্যাপক উপকারিতা বয়ে আনে। তাই আমরা অনেকেই আনারস খেতে পছন্দ করি। শুধু মৌসুমী ফলের স্বাদ পেতেই নয়, বরং সঠিক পদ্ধতিতে আনারস খেলে এর ব্যাপক উপকারিতা পাওয়া সম্ভব।
তাই আনারস খাওয়ার উপকারিতা পর্যাপ্তভাবে পেতে, আনারসের পুষ্টি উপাদান, আনারসের উপকারিতা ও অপকারিতা এবং খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন এই লেখা থেকে।
আনারসের পুষ্টি উপাদান
আনারস ফলটি নানারকম পুষ্টি উপাদানের ভরপুর থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম আনারসে যে সকল পুষ্টি উপাদানগুলো থাকে, সেগুলোর পরিমাণসহ নিচে তুলে ধরা হলো:
- ক্যালোরি: ৫০ ক্যালোরি
- পানি: ৮৬ গ্রাম
- কার্বোহাইড্রেট: ১৩.১২ গ্রাম
- চিনি: ৯.৮৫ গ্রাম
- ফাইবার: ১.৪ গ্রাম
- প্রোটিন: ০.৫৪ গ্রাম
- ফ্যাট: ০.১২ গ্রাম
- ভিটামিন সি: ৪৭.৮ মিলিগ্রাম (৮০% দৈনিক প্রয়োজন)
- ভিটামিন এ: ৩ মাইক্রোগ্রাম
- ভিটামিন বি৬: ০.১১২ মিলিগ্রাম
- থায়ামিন (ভিটামিন বি১): ০.০৭৯ মিলিগ্রাম
- রাইবোফ্লাভিন (ভিটামিন বি২): ০.০৩২ মিলিগ্রাম
- নায়াসিন (ভিটামিন বি৩): ০.৫০০ মিলিগ্রাম
- ফোলেট (ভিটামিন বি৯): ১৮ মাইক্রোগ্রাম
- প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড (ভিটামিন বি৫): ০.২১৩ মিলিগ্রাম
- ক্যালসিয়াম: ১৩ মিলিগ্রাম
- লোহা: ০.২৯ মিলিগ্রাম
- ম্যাগনেসিয়াম: ১২ মিলিগ্রাম
- ফসফরাস: ৮ মিলিগ্রাম
- পটাসিয়াম: ১০৯ মিলিগ্রাম
- সোডিয়াম: ১ মিলিগ্রাম
- জিঙ্ক: ০.১২ মিলিগ্রাম
আনারসের উপকারিতা | আনারস খাওয়ার উপকারিতা
আনারস খাওয়ার ব্যাপক উপকারিতা রয়েছে। এটি একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল হওয়ার পাশাপাশি আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এটি বিভিন্ন ভিটামিন এবং মিনারেল সরবরাহ করে। বিশেষ করে ভিটামিন সি এবং ম্যাঙ্গানিজের ভালো উৎস এই আনারস। আনারস খাওয়ার বহু উপকারিতা গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিচে তুলে ধরা হলো:
(১) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
আনারসের মধ্যে উচ্চ মাত্রার ভিটামিন সি থাকে, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ভিটামিন সি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এটি ফ্রি র্যাডিক্যাল দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতি প্রতিরোধ করে। এটি সর্দি-কাশি এবং অন্যান্য সংক্রমণ থেকেও দেহকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
(২) হজমশক্তি বৃদ্ধি করে
আনারসে ব্রোমেলাইন নামে একটি এনজাইম থাকে, যা প্রোটিন হজমে সাহায্য করে। এটি হজমশক্তি উন্নত করতে এবং পেটের অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া আনারস থাকা ফাইবার আমাদের হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে।
(৩) শরীর ডিটক্সিফাই করে
আনারসে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান শরীরের টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে। এটি লিভারের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং শরীরকে টক্সিন মুক্ত ও শক্তিশালী রাখে।
(৪) প্রদাহজনিত সমস্যা কমায়
আনারসে যেই ব্রোমেলাইন নামক এনজাইম থাকে, সেটি একটি প্রাকৃতিক প্রদাহরোধী উপাদান। এটি শরীরের প্রদাহজনিত সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। এটি আর্থ্রাইটিস, গিঁটের ব্যথা এবং অন্যান্য প্রদাহজনিত সমস্যার উপশমে কার্যকর। নিয়মিত আনারস খেলে শরীরের বিভিন্ন অংশের প্রদাহ কমানো যায়।
(৫) হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
আনারসে উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন, এবং মিনারেল থাকে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। পটাসিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজ হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এছাড়া আনারসের মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট LDL কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। ফলের হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশেই হ্রাস পায়।
(৬) হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখে
আনারসে উচ্চ মাত্রায় ম্যাঙ্গানিজ থাকে। এই ম্যাঙ্গানিজ হাড়ের স্বাস্থ্যে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ম্যাঙ্গানিজ হাড়ের গঠন ও শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এটি অস্টিওপোরোসিস এবং হাড়ের অন্যান্য সমস্যা প্রতিরোধেও কার্যকরী।
(৭) ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে
আনারসে ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকার কারণে ত্বকের সৌন্দর্য বাড়ে। ভিটামিন সি কোলাজেন উৎপাদন বাড়িয়ে ত্বককে টানটান ও উজ্জ্বল করে। এছাড়াও আনারসের মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের বয়সের ছাপ কমাতে সাহায্য করে।
(৮) ওজন কমাতে সহায়তা করে
আনারসের মধ্যে ক্যালোরি কম থাকে এবং ফাইবার বেশি থাকে, যা ওজন কমাতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, ফাইবার হজমশক্তি বাড়িয়ে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে রাখে। নিয়মিত আনারস খেলে শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমানো সহজ হয়।
(৯) চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখে
আনারসে থাকা ভিটামিন সি ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান গুলো চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়ক। ভিটামিন সি চুলের গোড়া শক্তিশালী করে এবং চুল পড়া রোধ করে। এছাড়া আনারসে থাকা ব্রোমেলাইন মাথার ত্বকের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
(১০) মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়ক
আনারসে থাকা বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেল মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করতেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। বিশেষত ভিটামিন বি কমপ্লেক্স এবং সেরোটোনিন উৎপাদনে সহায়ক পুষ্টি উপাদান মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং মন-মেজাজ ভালো রাখতে সাহায্য করে। আর এগুলো আনারসে বিদ্যমান।
নিয়মিত আনারস খাওয়ার মাধ্যমে উপরোক্তভাবে আপনি আপনার শরীরকে সুস্থ রাখতে পারবেন এবং আরো ভালো করতে পারবেন।
খালি পেটে আনারস খাওয়ার উপকারিতা
খালি পেটে আনারস খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। আনারসে প্রচুর ভিটামিন সি এবং ব্রোমেলাইন রয়েছে, যা খালি পেটে খেলে শরীরের ডিটক্সিফিকেশনে সহায়ক হয়। এটি পেটের হজমশক্তি উন্নত করে এবং গ্যাস, অম্বল ও কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করে। সাধারণত পেটের স্বাস্থ্য ভালো রাখতেই বাংলাদেশে খালি পেটে আনারস খাওয়ার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে।
খালি পেটে আনারস খেলে ব্রোমেলাইন প্রোটিন হজমে সহায়ক হয়। পরবর্তীতে এটি হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে। এছাড়া আনারসের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুলো ত্বকে ফ্রি র্যাডিক্যালের ক্ষতি প্রতিরোধ করে। এর ফলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়। আনারসে থাকা পুষ্টি উপাদানগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং শরীরকে সতেজ রাখে।
তবে খালি পেটে আনারস খেলে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে অম্বল বা অস্বস্তি হতে পারে। তাই ব্যক্তিগত সহনশীলতা অনুযায়ী খাওয়া উচিত।
গর্ভাবস্থায় আনারস খেলে কি হয়?
গর্ভাবস্থায় আনারস খেলে বেশ কিছু উপকারী প্রভাব পাওয়া যায়। সাধারণত আনারসে প্রচুর ভিটামিন সি থাকে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এতে থাকা ব্রোমেলাইন প্রোটিন হজমে সহায়ক এবং পেটের অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করে। আবার আনারসে ফাইবার থাকে, যা গর্ভাবস্থায় অন্যতম সাধারণ সমস্যা- কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সহায়তা করে।
এছাড়াও আনারসে থাকা ফোলেট গর্ভাবস্থায় শিশুর মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত আনারস খাওয়া কিছু ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। যেমন- অতিরিক্ত পরিমাণে আনারস খেলে, আনারসে থাকা ব্রোমেলাইন জরায়ুর সংকোচন ঘটাতে পারে। যার ফলে প্রাথমিক গর্ভপাতের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
এছাড়াও আনারস খেলে অম্বল বা অম্লতা হতে পারে, যা গর্ভাবস্থায় অস্বস্তি বাড়ায়। তাই গর্ভাবস্থায় আনারস খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, অথবা সীমিত পরিমাণে সেবন করতে পারেন।
আনারসে কোন এসিড থাকে?
আনারসে সাইট্রিক অ্যাসিড এবং অ্যাসকরবিক অ্যাসিড (ভিটামিন সি) থাকে। এই অ্যাসিডগুলো হজমশক্তি বাড়ায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
আনারসের অপকারিতা | আনারস খেলে কি ক্ষতি হয়
ব্যাপক উপকারিতার পাশাপাশি আনারসের কিছু অপকারিতা বা ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। সাধারণত অতিরিক্ত পরিমাণে আনারস খেলেই এর ক্ষতিকর দিকটি আমাদের দেহে প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত আনারস খেলে-
- পেটে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বৃদ্ধি পায়।
- অতিরিক্ত পরিমাণে আনারস খেলে, এপেক থাকা ব্রোমেলাইনের ফলে ডায়রিয়া হতে পারে।
- অনেক সময় দৈহিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়।
- গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত আনারস খেলে জরায়ুর সংকোচন হতে পারে, যা কিনা প্রাথমিক গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়াতে সক্ষম।
- কিছু মানুষের ক্ষেত্রে আনারসে অ্যালার্জি হতে পারে, যা ত্বকে ফুসকুড়ি, চুলকানি বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে।
আনারসের এ সকল ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিত্রান পেতে, পরিমিত পরিমাণে আনারস খাওয়া এবং কোন সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
শেষকথা
এই ছিল আনারসের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যবহুল আলোচনা। ধন্যবাদ।