কলার উপকারিতা ও অপকারিতা | কলা একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল যা সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রিয় একটি খাবার। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় কলা থাকলে, এটি শুধু স্বাদে কিংবা পুষ্টি চাহিদা পূরণে নয়, বরং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের উপকারী প্রভাব ফেলে।
সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে, জানি আমি তো ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম করে থাকে, তারা সকলেই কলা খেতে পছন্দ করে। কিন্তু এ সকল খাবারের পুষ্টিগুণ এবং উপকারী ও ক্ষতিকর দিকগুলো জেনে নেওয়া উচিত। তাই কলার উপকারিতা ও অপকারিতা এবং কলা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে নিন এই লেখা থেকে।
কলার পুষ্টি উপাদান
কলা একটি সুস্বাদু খাবার হওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক পুষ্টি উপাদান বহন করে থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম গলাতে যে সকল পুষ্টি উপাদান গুলো থাকে, সেগুলোর পরিমাণ সহ নিচে তুলে ধরা হলো:
- ক্যালরি: ৮৯ ক্যালরি
- কার্বোহাইড্রেট: ২২.৮৪ গ্রাম
- চিনি: ১২.২৩ গ্রাম
- ডায়েটারি ফাইবার: ২.৬ গ্রাম
- প্রোটিন: ১.০৯ গ্রাম
- ফ্যাট: ০.৩৩ গ্রাম
- ভিটামিন সি: ৮.৭ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি৬: ০.৩৬৭ মিলিগ্রাম
- পটাসিয়াম: ৩৫৮ মিলিগ্রাম
- ম্যাগনেসিয়াম: ২৭ মিলিগ্রাম
- ফসফরাস: ২২ মিলিগ্রাম
- ফোলেট (ভিটামিন বি৯): ২০ মাইক্রোগ্রাম
- পানি: ৭৪.৯১ গ্রাম
কলার ধরন ও আকৃতি অনুযায়ী এ সকল পুষ্টি উপাদানের পরিমাণের তারতম্য হতে পারে।
১ টি কলায় কত ক্যালরি?
একটি মাঝারি আকারের কলার আনুমানিক ওজন প্রায় ১১৫-১২০ গ্রাম। এ ধরনের কলায় সাধারণত ১০৫ ক্যালোরি থাকে। ছোট বা বড় কলার আকার অনুসারে ক্যালোরির পরিমাণ কিছুটা কম বা বেশি হতে পারে।
কলার উপকারিতা | কলা খাওয়ার উপকারিতা
কলা অধিক মাত্রার পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হওয়ায় এটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এ সকল উপকারিতা আছে বলেই তো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মাঝে এটি খাওয়ার জনপ্রিয়তা রয়েছে। কলার বহুল উপকারিতা গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিচে তুলে ধরা হলো:
(১) হজমে সহায়তা করে
কলাতে উপস্থিত ফাইবার হজম প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে। এই ফলের মধ্যে থাকা দ্রবণীয় ফাইবার পেটের সমস্যা দূর করতে এবং হজমশক্তি বাড়াতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। যারা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভুগছে, তাদের জন্য কলা একটি প্রাকৃতিক প্রতিকার হিসেবে কাজ করে। এটি প্রাকৃতিকভাবে পেট পরিষ্কার রাখতে এবং খাদ্য হজমে সাহায্য করে।
(২) দেহে শক্তি সরবরাহ করে
কলায় প্রাকৃতিক চিনি রয়েছে, যা আমাদের দেহে দ্রুত শক্তি প্রদান করে। এজন্য, এটি খেলোয়াড় এবং ব্যায়ামকারীদের মধ্যে জনপ্রিয়। সকালের নাস্তা বা ব্যায়ামের পর একটি কলা খাওয়া দ্রুত শক্তি যোগায় এবং শরীরকে সতেজ রাখে। পাশাপাশি কলা ক্লান্তি দূর করে এবং শরীরে সজীবতা নিয়ে আসে।
(৩) হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে
কলায় পটাসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম প্রচুর পরিমাণে থাকে, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। নিয়মিত কলা খাওয়া হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। পটাসিয়াম শরীর থেকে অতিরিক্ত সোডিয়াম বের করতে সাহায্য করে, যা রক্তচাপ কমাতে সহায়ক। ফলে হৃদপিণ্ড সুস্থ থাকে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায়।
(৪) মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন করে
কলায় ট্রিপটোফ্যান নামে একটি উপাদান থাকে, যা শরীরে সেরোটোনিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। সেরোটোনিন একটি নিউরোট্রান্সমিটার, যা মেজাজ ভালো রাখতে সাহায্য করে। ফলে নিয়মিত কলা খেলে মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমে এবং মন ভালো থাকে। এছাড়া কলার মধ্যে থাকা ভিটামিন বি৬ও মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়াতেও সহায়ক।
(৫) ত্বকের যত্নে কার্যকরী
কলার মধ্যে থাকা ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। এটি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে, ত্বককে মসৃণ করতে এবং বলিরেখা কমাতে কার্যকরী। সৌন্দর্য বিলাসী অনেকেই কলার পেস্ট তৈরি করে তা মুখে লাগিয়ে থাকেন। এতে করে ত্বক মসৃণ ও কোমল থাকে।
(৬) ওজন কমাতে সহায়তা করে
যারা ওজন কমানোর চেষ্টা করছে, তাদের জন্য কলা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী খাদ্য উপাদান। কলায় কম ক্যালোরি থাকে এবং এটি অনেকক্ষণ পেট ভরিয়ে রাখে। ফলে ক্ষুধার পরিমাণ কমে এবং অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা হ্রাস পায়।
(৭) অ্যানিমিয়া প্রতিরোধে সহায়ক
কলায় আয়রন রয়েছে, যা রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে সহায়তা করে। এটি অ্যানিমিয়া প্রতিরোধেও কার্যকর ভূমিকা পালন করে। যারা রক্তস্বল্পতায় ভুগছে, তারা নিয়মিত কলা খেলে উপকার পাওয়া যাবে।
(৮) হাড়ের যত্নে উপকারী
কলায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম ও পটাসিয়াম রয়েছে। এই উপাদানগুলো হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। এটি হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে এবং হাড়কে মজবুত করতে সহায়তা করে। তাই বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাড়ের যে ক্ষয় হয়, তা প্রতিরোধে করতে কলা কার্যকরী প্রভাব ফেলবে।
(৯) রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে
কলায় পটাসিয়াম বেশি পরিমাণে থাকায় এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। নিয়মিত কলা খেলে রক্তচাপের মাত্রা স্থিতিশীল থাকে এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে।
নিয়মিত কলা খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য নানা দিক থেকে উপকারী হয়ে থাকে। তাই আপনার দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় কলা অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
সকালে কলা খাওয়ার উপকারিতা
সকালে কলা খাওয়া অনেকর জন্যই অত্যন্ত উপকারী হতে পারে। এটি দ্রুত শক্তি প্রদান করে এবং দিন শুরুতে কর্মক্ষম হতে সহায়তা করে। কলায় থাকা প্রাকৃতিক চিনি, ফাইবার ও পটাসিয়াম শরীরকে সতেজ রাখে ও হজমশক্তি বাড়ায়। এছাড়া কলার পটাসিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
সকালে কলা খেলে মেজাজ ভালো থাকে কারণ এতে ট্রিপটোফ্যান রয়েছে যা সেরোটোনিনের মাত্রা বাড়ায়। ওজন নিয়ন্ত্রণেও সকালে কলা খাওয়া কার্যকরী। কারণ এটি কম ক্যালোরি যুক্ত এবং দীর্ঘ সময় পেট ভরা রাখে। সারাদিনের শক্তির জন্য সকালে একটি কলা হলো আদর্শ খাবার। তবে অনেকের জন্য এটি গ্যাস্ট্রিক কিংবা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে।
খালি পেটে কলা খেলে কি হয়?
খালি পেটে কলা খাওয়া কিছু লোকের জন্য উপকারী, আবার কিছু লোকের জন্য জটিল স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। কলায় উচ্চ মাত্রার ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাসিয়াম থাকে, যা খালি পেটে খেলে রক্তের ম্যাগনেসিয়াম ও পটাসিয়ামের মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে এবং এর ফলে অস্বস্তি বা হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।
এছাড়া কলায় থাকা প্রাকৃতিক চিনি খালি পেটে খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। এই অবস্থাটি কিছু মানুষের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই খালি পেটে কলা খাওয়ার আগে ব্যক্তিগত শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
কলা খাওয়ার সঠিক সময়
কলা খাওয়ার সঠিক সময় নির্ভর করে ব্যক্তির দৈনন্দিন রুটিন এবং স্বাস্থ্যের ওপর। সাধারণত সকালের নাস্তার সময় কলা খাওয়া উপকারী। কারণ এটি দ্রুত শক্তি প্রদান করে এবং দীর্ঘক্ষণ পেট ভরিয়ে রাখে। ব্যায়াম বা ওয়ার্কআউটের আগে বা পরে কলা খেলে শক্তি বজায় থাকে এবং পেশির পুনর্গঠনে সহায়ক হয়। দুপুরের খাবারের পর মিষ্টি হিসেবে কলা খাওয়া যায়।
তবে রাতে বা ঘুমানোর আগে কলা খাওয়া এড়ানো উচিত। কারণ এতে থাকা প্রাকৃতিক চিনি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তাই আপনারা ব্যক্তিগত শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে কলা খাওয়ার সময় নির্ধারণ করতে পারেন।
অতিরিক্ত কলা খাওয়ার অপকারিতা
অতিরিক্ত কলা খেলে আমাদের স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কলা খাওয়ার ক্ষতিকর দিকগুলো হলো:
- অতিরিক্ত কলা খেলে ক্যালোরি ও শর্করা বেশি পরিমাণে শরীরে প্রবেশ করে। ফলে ওজন বৃদ্ধি পায়।
- কলা উচ্চ শর্করা যুক্ত ফল। অতিরিক্ত খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ক্ষতিকর।
- অতিরিক্ত কলা খেলে হজমে সমস্যা, গ্যাস এবং বমিভাব হতে পারে।
- অতিরিক্ত কলা খেলে রক্তে পটাসিয়ামের মাত্রা বেড়ে হাইপারক্যালেমিয়া হতে পারে, যা হৃদযন্ত্রের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
- কিছু মানুষের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কলা খেলে মাইগ্রেনের তীব্রতা বাড়াতে পারে।
- শরীরের পুষ্টির ভারসাম্য নষ্ট হয়।
তাই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখতে পরিমিত পরিমাণে কলা খাওয়া উচিত।
শেষকথা
উপরোক্তা আলোচনা থেকে কলার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে জানলেন। স্বাস্থ্যবান থাকতে পরিমিত পরিমাণে নিয়মিত এই সুস্বাদু ফলটি খেতে পারেন। ধন্যবাদ।