আদিকাল থেকে মৌমাছি মানুষের নিকট অতি পরিচিত এক প্রকার ক্ষুদ্র, পরিশ্রমী ও উপকারী পতঙ্গ। এই মৌমাছির মাধ্যমে আমরা প্রকৃতির অন্যতম গুনবাচক ও পুষ্টিকর খাবার – ‘মধু’ পেয়ে থাকি।
বর্তমানে প্রাকৃতিকভাবে ছাড়াও খামার ব্যবসার মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে মৌমাছি পালন করা যায়। তারপর মৌমাছি থেকে মধু ও মোম উৎপাদন করে স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে অনলাইনে বা ফেসবুক মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে উৎপাদিত মধু বিক্রি করা যায়।
অনেকেই এই মৌমাছি চাষ বা মৌমাছি পালনের ব্যবসাটি শুরু করতে চাচ্ছেন। এমন উদ্যোক্তা ভাইদের সুবিধার জন্য এই আর্টিকেলে মৌমাছি পালন বা মৌমাছি চাষের ব্যবসা করার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
লাভজনক মৌমাছি পালন ব্যবসা
মধু উৎপাদন একটি জনপ্রিয় ও লাভজনক ব্যবসা। মৌমাছি চাষ মধু উৎপাদন, মোম উৎপাদন ও ওষুধ উৎপাদনে সহায়তা করে। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত অত্যন্ত স্বাস্থ্যসম্মত এবং বিভিন্ন গুণসম্পন্ন খাদ্য উপাদান মধু। প্রাকৃতিক মধুর চাহিদা সমত্রই অনেক বেশি। আপনার বাড়ির পাশে ছোট একটি জায়গা নিয়েও মধু চাষ শুরু করতে পারবেন।
মধু আমাদের স্বাস্থ্য ও রূপচর্চার জন্য অনেক বেশি উপকারি। বর্তমানে খাটি মধুর চাহিদা অনেক বেশি । সম্প্রতি অনলাইনে অনেকেই মধু কেনা-বেচা করে অনেক বেশি উপার্জন করছে অল্প পুজিতেই। চাষকৃত মধু উচ্চ দামে অনলাইনে বা অফলাইনে বিক্রি করতে পারবেন। বর্তমানে প্রতি কেজি প্রাকৃতিক মধু ৫০০-৯০০ টাকা মূল্যে বিক্রি করা যায়।
তাছাড়া মৌমাছিরা ফুলের পরাগায়ন ঘটিয়ে বনজ, ফলদ ও কৃষিজ ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। কোন কোন প্রকার মৌমাছি বাক্সবন্দী করে লালন-পালন বা চাষ করা যায়। এবং অধিকতর লাভবান হওয়া যায়।
আপনার বাড়ির আশেপাশে কিছুটা ফাকা জায়গা থাকলেই মৌমাছি পালন করে মধু উৎপাদন শুরু করতে পারবেন। উৎপাদন্মুখী ব্যবসায় হওয়ায় ভবিষ্যতে ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধি করার জন্যও উপযুক্ত।
আরও পড়ুনঃ লাভজনকভাবে ফুলের দোকানের ব্যবসা করার গাইডলাইন।
মৌমাছির বিভিন্ন প্রজাতি

আমাদের দেশে সাধারণত তিন প্রজাতির মৌমাছি পাওয়া যায়। যথা:
- পাহাড়ী মৌমাছি,
- ভারতীয় মৌমাছি ও
- ক্ষুদে মৌমাছি।
নিচে এগুলোর বৈশিষ্ট্য এবং মধু উৎপাদন সক্ষমতার ধারনা দেওয়া হলো:
(১) পাহাড়ী মৌমাছি
এই জাতের মৌমাছি আকারে অন্যান্য মৌমাছির জাতের চেয়ে বড়। সাধারণত বড় বড় গাছের ডালে, পাহাড়ের গায়ে এরা চাক বাঁধে। এগুলোর প্রতি চাকে প্রতিবারে গড়ে প্রায় ১০ কেজি মধুর উৎপাদন হয়। এই জাতের মৌমাছি পোষ মানে না তাই বাক্সে লালন-পালন করা যায় না।
(২) ভারতীয় মৌমাছি
ভারতীয় জাতের মৌমাছির আকার মাঝারি ধরনের হয়। অন্ধকার বা আড়াল করা স্থান, যেমন গাছের ফোকর, দেওয়ালের ফাটল, আলমারি, ইটের স্তুপ ইত্যাদি স্থানে এরা চাক বাঁধে।
এগুলোর প্রতি চাকে প্রতিবারে গড়ে প্রায় ৪ কেজি মধুর উৎপাদন হয়। এরা শান্ত প্রকৃতির। তাই বাক্সে লালন-পালন করা যায়।
(৩) ক্ষুদে মৌমাছি
এই জাতের মৌমাছি আকারে অন্যান্য মৌমাছির জাতের চেয়ে ছোট হয়। এরা ঝোপ জাতীয় গাছের ডালে, পাতা ও শুকনো কাঠি ইত্যাদিতে চাক বাঁধে।
এগুলোর চাকের আকার খুব ছোট হয়। এগুলোর প্রতি চাকে প্রতিবারে গড়ে প্রায় ২০০ গ্রাম মধুর উৎপাদন হয়। এগুলো শান্ত প্রকৃতির হয়। তবে এক স্থানে বেশিদিন থাকেনা।
তাই মৌমাছি চাষ করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হবে ভারতীয় জাতের মৌমাছি পালন করা।
আরও পড়ুনঃ লাভজনকভাবে কবুতর পালন পদ্ধতি।
মৌমাছি পালনের জন্য কি কি লাগে?
গ্রাম্য পরিবেশে হলে, মাত্র ৫,০০০ টাকা পুঁজিতেও মধু উৎপাদন শুরু করা যায়। তবে বানিজ্যিকভাবে করলে ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকাও বিনিয়োগ করতে পারেন। যাইহোক, প্রাথমিকভাবে ব্যবসা শুরু করতে প্রয়োজন হবে:
- মৌমাছি জোগাড় করা বা ক্রয় করা (প্রাথমিকভাবে ছোট পরিসরে শুরু করতে পারেন।)
- মৌমাছি চাষের জন্য খাঁচা তৈরি বা চাক ক্রয়।
- সম্ভব হলে সূর্যমুখী, সরিষা ইত্যাদি ফুলের আশেপাশে হালকা প্রসারিত জায়গা।
- সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিবহনে এবং মধু হোম ডেলিভারিতে প্রাথমিকভাবে কিছু টাকা ইনভেস্ট করা।
- অনলাইনে ব্যবসার জন্য একটি ফেসবুক পেইজ খোলা।
এছাড়া খামারের পাশে ভালো পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
চাষের জন্য মৌমাছি সংগ্রহ ও কৃত্রিম খাবার
প্রকৃতি থেকে ভারতীয় মৌমাছি (রাণী মৌমাছি ও কিছু শ্রমিক মৌমাছি) সংগ্রহ করে অথবা প্রতিষ্টিত মৌচাষীর নিকট থেকে ক্রয় করে মৌমাছি পালন শুরু করতে পারবেন।
মৌমিছিগুলো বাক্সবন্দীর প্রথম ৩/৪ দিন কৃত্রিম খাবার যথা চিনির ঘন সরবত বা সিরাপ দেওয়ার প্রয়োজন হয়। এরপর মৌমাছিরা নিজেদের খাবার নিজেরা সংগ্রহ করে থাকে।
কখনো কখনো পরিবেশে খাবার ঘাটতি পড়লেও কৃত্রিম খাবার দেওয়ার প্রয়োজন হয়। মৌচাক খামারিদের সেসকল বিষয়ে ভালোভাবে জেনে দক্ষতা অর্জন করে নিতে হবে ব্যবসা শুরুর আগেই।
আরও পড়ুনঃ লাভজনকভাবে কোয়েল পাখি পালন পদ্ধতি।
মধু ও মোম উৎপাদন
মধু মৌমাছির তৈরী এক প্রকার উপাদেয় খাদ্য। সাধারণত মৌমাছিরা ফুলের মিষ্টি রস শুষে নিয়ে তা তাদের পাকস্থলীর উপরের এক বিশেষ অঙ্গে জমা করে। এই অঙ্গকে মৌমাছির মধুথলি বলে।
ফুলের মিষ্টি রস মধুথলিতে জমা করার সময় মৌমাছিরা এর সাথে লালা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন উৎসেচক মেশায়। এর ফলে মিষ্টি রস পরিবর্তিত হয়ে আংশিক মধু তৈরী হয়। তারপর মৌমাছিরা সেগুলোকে চাকে এনে ঢেলে দেয় মধু রাখার খোপগুলোতে।
এসময় মৌমাছিরা ছুটে এসে ঐ মধু আবার মুখে ভরে এবং তাদের লালার সাথে পূণরায় মিশিয়ে তৈরী করে আসল মধু এবং তা মৌমাছির খোপে জমা করে রাখে। তারপর মৌমাছিরা জোরে ডানা নেড়ে খোপে রক্ষিত মধু থেকে বাড়তি পানি সরিয়ে দেয়।
এভাবে এক সময় ফুলের মিষ্টি রস হয়ে যায় ঘন মধু। মূলত মৌমাছিরা এই মধু জমা রাখে নিজেদের ও বাচ্চাদের খাবার হিসাবে। মধু জমা রাখার পর খোপগুলোর মুখ মোম দিয়ে বন্ধ করে দেয়।
অন্যদিকে, মৌমাছির পেটের তলায় পকেটের মত ভাজ থাকে মোমগ্রন্থি। সেখানে তৈরী হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতের মত মোম কণা। এই মোম দিয়েই মৌমাছিরা বাসা বানায়। আর এভাবেই মৌমাছির মাধ্যমে মধু ও মোম উৎপন্ন হয়।
চাক থেকে মধু সংগ্রহ করার পদ্ধতি
মধু সংগ্রহ করার সময় আস্ত চাক হাত দিয়ে চিপে মধু বের করা হয়। এই মধুতে মৌমাছির দেহের অংশ ও বজ্য পদার্থ বিদ্যমান থাকে।
এছাড়া এ ধরনের মধু অল্প দিনের মধ্যেই পচে নষ্ট হয়ে যায়। অপরদিকে, বাক্সে লালন-পালন করা মৌমাছির চাক থেকে মধু নিষ্কাশন যন্ত্রের সাহায্যেও মধু বের করা যায়। এতে চাক থেকে শুধু মধু বের হয়ে আসে, অথচ চাক নষ্ট হয় না এবং তা আবারও ব্যবহার করা যায়।
আরও পড়ুনঃ লাভজনক ৭টি ৫০ হাজার টাকায় ব্যবসা আইডিয়া।
বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট – মৌমাছি পালন কর্মসূচী
চট্রগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের বন রক্ষণ বিভাগ ২০০০-২০০১ অর্থবছরে “কৃষি গবেষণা ব্যবস্থাপনা প্রকল্প” এর আর্থিক সহায়তায় সছি প্রতিষ্ঠানের “খামার পদ্ধতি গবেষণা ও উন্নয়ন” কর্মসূচীর আওতায় মৌমাছি পালন কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল।
এই কর্মসূচীর মাধ্যমে বান্ধরবান পার্বত্য জেলার মার্মা, মুরং, তংচইংগা, হিন্দু ও মুসলমান ও ফাইতং নামক – এই তিনটি স্থানে মৌমাছি পালনকে একটি সম্ভাবনাময় ও লাভজনক কর্মকান্ড হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। সেই প্রকল্পের আওতায় যুক্ত হয়ে অথবা, ‘হানি কাল্টিভেশন ট্রেনিং সেন্টার ইন বাংলাদেশ’ -থেকে অনলাইনে বা সরাসরি প্রতিষ্ঠান থেকে মধু উৎপাদনের প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন।
মৌমাছি পালনের উপকারী দিকসমূহ
- মৌমাছি পালন ব্যবসাটি দেশে খাটি মধুর চাহিদা পূরণ করে পুষ্ঠিহীনতা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
- মধু শর্করা জাতীয় খাদ্য এবং এতে বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন, এনজাইম ও খনিজ পদার্থ থাকে।
- মধু বিভিন্ন রোগের জীবানুনাশক হিসাবে ব্যবহার করা হয়। যেমন: সর্দি, কাশি, বাত, ব্যাথা ইত্যাদি।
- মোম, মোমবাতি, প্রসাধন (কোল্ড ক্রীম, সেভিং ক্রীম, স্নো ইত্যাদি) ঔষধ বিভিন্ন মলম তৈরীতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে মৌমাছির মোম।
- মধু ও মোম বিক্রয় করে বাড়তি আয়ের সংস্থানের মাধমে পারিবারিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পায়।
- ফুলের পরাগায়নের মাধ্যমে কৃষিজ, ফলদ ও বনজ গাছ-পালার ফলন ও গুণগতমান বৃদ্ধি করে ও জীব বৈচিত্রে সংরক্ষনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সার্বিকভাবে মৌমাছি পালন ব্যবসাটি অত্যন্ত লাভজনক এবং উপকারী একটি উৎপাদনমুখী ব্যবসা।
আরও পড়ুনঃ সেরা ৬টি ২ লাখ টাকায় লাভজনক ব্যবসা আইডিয়া।
মৌমাছি পালনে আয়/ লাভ
মৌমাছি পালনের আয় ও ব্যয় নির্ভর করে মধু উৎপাদন ও বাজার চাহিদার উপর। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে মৌমাছি পালন করলে এবং এলাকায় পর্যাপ্ত সহায়ক গাছ-পালা থাকলে, শীতকালে একটি বাক্স থেকে ৭/৮ কেজি মধু এবং বছরে ১৮/২০ কেজি খাটি মধু সংগ্রহ করা যায়।
এক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যাক,
উৎপাদিত মধু ১৫ কজি। প্রতি কেজি মধুর বাজারমূল্য ৩০০ টাকা। তাহলে মোট বিক্রয় = ৪,৫০০ টাকা।
এই পরিমান মধু চাষের জন্য আপনার ব্যয় হবে:
মৌমাছির বাক্সের দাম ৭০০ টাকা, মৌমাছির দাম ৭০০ টাকা, কৃত্রিম খাদ্য ৫০ টাকা, অন্যান্য খরচ ৫০ টাকা। অর্থাৎ, সর্বমোট ১,৫০০ টাকা।
এক্ষেত্রে মাত্র ১,৫০০ টাকা বিনিয়োগে আপনার লাভ হতে পারে ৩,০০০ টাকা। এভাবে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়লে লাভের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। আশাকরি সম্পূর্ন আলোচনাটি বুঝতে পেরেছেন।