আতা ফলকে আমাদের দেশে শরিফা বা নোনা নামেও ডাকা হয়। যদিও নোনা শব্দটি বাংলা সাহিত্যে আগে প্রচুর ব্যবহার হতো। কিন্তু এখনই আতা ফলটিকে শুধু আতা ও শরিফা বলেই ডেকে থাকে। আতা এই বাংলা অঞ্চলের ফল। এটা ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলেও জন্মে থাকে। ব্রিটিশরা যখন এ দেশে আসলো তখন প্রতিটা ফলের নিজস্ব নামকরণ করে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এরা নতুন কোনো ফল দেখলে সেটা সাথে আপেল শব্দটি যুক্ত করে। যেমন ধরুন এই আতাফল এর কয়েকটা নাম ওরা দেয়, custard apple, sugar Apple, sugar pineapple.
আতাফল আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয়। এটা দেখতে যেমন সুন্দর, খেতেও তেমন মিষ্টি সুস্বাদু। আজ এই আতা ফলের উপকারিতা ও অপকারিতা নিয়ে এই আর্টিকেল আলোচনা করা হবে।
আতা ফলের পুষ্টিমান
আতা ফল সুস্বাদু হওয়ার পাশাপাশি এটাই রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ। ১০০ গ্রাম আতা ফলের পুষ্টিমান সম্মুহ নিচে দেওয়া হলো—
- ক্যালোরি ৯৪ কিলো জুল
- কার্বোহাইড্রেট ২৩.৬ গ্রাম
- সুগার ১৯.৩ গ্রাম
- ফাইবার ৪.৪ গ্রাম
- প্রোটিন ২.১১ গ্রাম
- ফ্যাট ০.৩ গ্রাম
- ভিটামিন সি ৩৫-৪০ মিলি গ্রাম
- ভিটামিন এ ৫ IU
- ভিটামিন বি৬ ০.২ মিলি গ্রাম
- ভিটামিন বি৩ ০.৫ মিলি গ্রাম
- পটাশিয়াম ৩৮২ মিলি গ্রাম
- ম্যাগনেসিয়াম ১৮ মিলি গ্রাম
- ক্যালসিয়াম ২৪ মিলি গ্রাম
- আয়রন ০.৬ গ্রাম
- ফসফরাস ২১ মিলি গ্রাম
*এই ফলে অধিক পরিমাণে সুগার আছে। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের ডায়াবেটিস যদি বেশি পরিমাণে থাকে তাহলে এই ফল খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
আতা ফলের উপকারিতা
আতা ফল খাওয়ার অনেক উপকারিতা রয়েছে। এটি পুষ্টিকর একটি ফল, যা বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। আতা ফল খাওয়ার কিছু প্রধান উপকারিতা নিচে উল্লেখ করা হলো—
- হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক: আতা ফলে উচ্চমাত্রার পটাসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম রয়েছে, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এটি রক্তনালীগুলোর প্রসারণ ঘটিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং রক্ত সঞ্চালনকে উন্নত করে।
- আরও পড়ুন: আঙ্গুর এর উপকারিতা ও অপকারিতা
- ইমিউন সিস্টেম উন্নত করে: আতা ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে, যা একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং বিভিন্ন সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
- পাচনতন্ত্রের জন্য উপকারী: আতা ফলের ফাইবার কনটেন্ট বেশ উচ্চ, যা হজমশক্তি বাড়াতে সহায়তা করে। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং হজম প্রক্রিয়াকে সুস্থ রাখে। এছাড়া এটি অন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষায়ও সহায়ক।
- ত্বকের স্বাস্থ্য উন্নত করে: ভিটামিন সি এবং অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উপস্থিতি ত্বকের জন্য খুবই উপকারী। আতা ফল নিয়মিত খেলে ত্বক উজ্জ্বল ও সজীব থাকে, এবং বলিরেখা বা অন্যান্য বয়সজনিত চিহ্ন কমাতে সাহায্য করে।
- ওজন কমাতে সহায়ক: আতা ফলে ফ্যাটের পরিমাণ খুবই কম এবং ফাইবারের পরিমাণ বেশি। ফলে এটি দ্রুত তৃপ্তি এনে দেয় এবং অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমায়, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
- চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করে: আতা ফলে রিবোফ্লাভিন ও ভিটামিন এ রয়েছে, যা চোখের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এটি চোখের বিভিন্ন সমস্যা যেমন রাতকানা রোগ ও দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি প্রতিরোধে সহায়ক।
- হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো: এই ফলে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের উপস্থিতি হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এটি হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে সাহায্য করে এবং দাঁতের এনামেল রক্ষায় সহায়তা করে।
- অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গুণাবলী: আতা ফল বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা শরীরের ফ্রি র্যাডিক্যালদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এটি বার্ধক্যজনিত প্রভাব কমায় এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করে।
- স্মৃতিশক্তি বাড়ায়: আতা ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি৬ থাকে, যা স্নায়ুর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। এটি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে এবং স্মৃতিশক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে। নিয়মিত আতা ফল খেলে মনোযোগ ও শিখন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
- মূত্রবর্ধক হিসেবে কাজ করে: আতা ফল একটি প্রাকৃতিক মূত্রবর্ধক হিসেবে কাজ করে। এটি শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি ও বিষাক্ত পদার্থ বের করে দিতে সাহায্য করে। এর ফলে কিডনির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের ঝুঁকি কমে।
- এনার্জি বুস্টার: আতা ফলে কার্বোহাইড্রেটের উপস্থিতি শরীরে শক্তি যোগাতে সহায়ক। এটি দ্রুত এনার্জি সরবরাহ করে এবং ক্লান্তি দূর করে। এটি একটি প্রাকৃতিক এনার্জি বুস্টার হিসেবে কাজ করতে পারে, বিশেষ করে যখন দ্রুত এনার্জি প্রয়োজন হয়।
- চুলের স্বাস্থ্য রক্ষা করে: আতা ফলে উপস্থিত ভিটামিন সি এবং আয়রন চুলের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। এটি চুলের শুষ্কতা দূর করে, খুশকি প্রতিরোধ করে এবং চুলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। নিয়মিত আতা ফল খেলে চুল মজবুত ও উজ্জ্বল হয়।
- হাঁপানি ও ব্রঙ্কাইটিসে উপকারী: আতা ফলের অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণাবলী শ্বাসতন্ত্রের সমস্যাগুলি যেমন হাঁপানি এবং ব্রঙ্কাইটিসের উপশমে সহায়ক হতে পারে। এটি শ্বাসতন্ত্রকে সুরক্ষা দেয় এবং শ্বাস নিতে সুবিধা করে।
- আকস্মিক হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করে: আতা ফলে ম্যাগনেশিয়াম উপস্থিত থাকায় এটি আকস্মিক হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করতে সহায়ক। এটি হৃদপিণ্ডের পেশিগুলোকে শক্তিশালী করে এবং সঠিক রক্ত সঞ্চালন নিশ্চিত করে।
- মস্তিষ্কের শক্তি বৃদ্ধি করে: আতা ফলে প্রচুর পরিমাণে গ্লুকোজ ও ফ্যাট থাকে, যা মস্তিষ্কের শক্তি যোগায়। এটি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং মানসিক চাপ কমায়।
- হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে: আতা ফলের পেপটাইডেস এবং অ্যামিনো অ্যাসিড হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে এবং শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়। এটি অন্ত্রের প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
- ব্যথা ও প্রদাহ কমায়: আতা ফলের অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান ব্যথা ও প্রদাহ কমাতে সহায়ক। এটি প্রাকৃতিক পেইন রিলিভার হিসেবে কাজ করে, বিশেষ করে আর্থ্রাইটিস ও গাউটের মতো ব্যথাযুক্ত অবস্থায়।
- নিদ্রাহীনতা দূর করে: আতা ফলে ম্যাগনেশিয়াম ও ট্রিপটোফান উপস্থিত থাকায় এটি ঘুমের মান উন্নত করে এবং নিদ্রাহীনতা দূর করে। এটি শরীরকে শান্ত করে এবং রাতের ঘুমকে গভীর করে তোলে।
আতা ফলের অপকারিতা
যদিও আতা ফল স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী, তবে কিছু ক্ষেত্রে এর কিছু অপকারিতা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও থাকতে পারে। নিচে আতা ফলের কিছু সম্ভাব্য অপকারিতা উল্লেখ করা হলো—
- ওজন বৃদ্ধি: আতা ফলে উচ্চমাত্রায় কার্বোহাইড্রেট ও ক্যালোরি থাকে। অতিরিক্ত পরিমাণে আতা ফল খাওয়া ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে, বিশেষ করে যদি এটি অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া হয় এবং শারীরিক সক্রিয়তা কম থাকে।
- রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি: আতা ফলে প্রাকৃতিক চিনি থাকে যা রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি করতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি সতর্কতার সঙ্গে খাওয়া উচিত, কারণ অতিরিক্ত আতা ফল খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বেড়ে যেতে পারে।
- জেনে নিন: আপেল এর উপকারিতা ও অপকারিতা
- অ্যালার্জি: কিছু মানুষের জন্য আতা ফল অ্যালার্জি সৃষ্টি করতে পারে। অ্যালার্জির লক্ষণগুলির মধ্যে ত্বকের ফুসকুড়ি, চুলকানি, মুখে ফোলাভাব বা শ্বাসকষ্ট দেখা যেতে পারে। তাই যারা আগে থেকে ফলের প্রতি সংবেদনশীল, তাদের আতা ফল খাওয়ার আগে সতর্ক থাকা উচিত।
- অন্ত্রের সমস্যা: আতা ফলে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে, যা সাধারণত হজম প্রক্রিয়ার জন্য ভালো। তবে অতিরিক্ত ফাইবার গ্রহণের ফলে গ্যাস, ফোলাভাব, এবং অন্ত্রের অস্বস্তি হতে পারে।
- পীড়াদায়ক বীজ: আতা ফলের বীজ সাধারণত বিষাক্ত এবং এটি খাওয়া উচিত নয়। বীজ চিবিয়ে বা ভেঙে খাওয়া হলে বিষক্রিয়া হতে পারে। এটি পেটে ব্যথা, বমি, বা অন্যান্য গুরুতর শারীরিক সমস্যার কারণ হতে পারে।
- হজম সমস্যা: যদি আতা ফল অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া হয়, তাহলে এটি হজমের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে যদি ফলটি পাকা না হয়, তাহলে কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- ক্ষতিকারক রসায়নিক: কিছু আতা ফলের বীজ ও পাতায় অ্যানোনাসিন নামক একটি বিষাক্ত যৌগ থাকে, যা দীর্ঘমেয়াদে স্নায়বিক ক্ষতি করতে পারে। মাথা ব্যাথা, বমি ভাব, প্রচণ্ড পেটে ব্যথা হতে পারে এর বিচি চিবিয়ে খেলে।
- গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ঝুঁকি: গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে আতা ফল খাওয়ার সময় সতর্ক থাকা উচিত। যদিও সাধারণভাবে আতা ফল নিরাপদ, তবে অতিরিক্ত খেলে গর্ভাবস্থায় শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি করতে পারে, যা গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- দাঁতে সমস্যা: আতা ফলে প্রাকৃতিক চিনি বেশি থাকায় অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে দাঁতের ক্ষয় হতে পারে। যারা নিয়মিত আতা ফল খায়, তাদের জন্য নিয়মিত দাঁতের যত্ন নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
- ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ: কিছু ক্ষেত্রে আতা ফল সংরক্ষণ বা পরিবহনের সময় ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়, যা ফলের পুষ্টিগুণ নষ্ট করতে পারে এবং স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
- এই কারণগুলোর জন্য আতা ফল খাওয়ার সময় পরিমিত মাত্রায় খাওয়া এবং সতর্ক থাকা গুরুত্বপূর্ণ। কোনো ব্যক্তির যদি আতা ফল খাওয়ার পরে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তবে তাদের একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
উপসংহার
একটা সময় এই আঁতফল আমাদের বাড়ির আঙিনায়, গ্রামীন বন জঙ্গলে অনেক হয়ে থাকতো। এ আতা ফল শুধু যে মানুষ খেত তা কিন্তু নয়। অসংখ্য পাখি এই ফল খেয়ে জীবন ধারণ করত। কিন্তু বনাঞ্চল ধ্বংসের মাধ্যমে গাছপালা কমে যাওয়ায় পাখির খাদ্য কমে গেছে। প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া এই ফলটির গুরুত্ব দেওয়া কমে গেছে। এইজন্য কারো বাসায় বেড়াতে গেলে দেশীয় ফলের বদলে বিদেশি ফল আপেল, আঙ্গুর, কমলা এগুলো নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের উচিত দেশি ফলগুলো খাওয়া ও এর চাষাবাদ করা।
ইদানিং বেশ কিছু জায়গায় এর চাষ শুরু হয়েছে। বাজারেও এর দেখা মিলছে। তবে এটার প্রচার-প্রচারণা আরো বেশি হলে এটার বিক্রিও বেশি হবে। জাঙ্কফুড পরিত্যাগ করে আমাদেরকে ফল গ্রহণের দিকে উৎসাহী হতে হবে। এতে করে আমাদের সুস্বাস্থ্য বজায় থাকবে।