আঙ্গুর আমাদের অতি পরিচিত একটি ফল। যদিও এটা আমাদের দেশে তেমন একটা চাষ হয় না। চাষ হয় না বললেই চলে। প্রতিবছর এটা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আঙ্গুর ফল লতা জাতীয় উদ্ভিদ থেকে হয়। বাংলায় এটাকে দ্রাক্ষালতা বলে। আঙ্গুর ফল কালো, নীল, হালকা সোনালী, সবুজ, বেগুনি-লাল বা সাদা রঙেরও হয়। তবে আমাদের দেশে সবুজ ও কালো রঙের আঙ্গুর বেশি পাওয়া যায়। এগুলো বেশিরভাগ ভারত থেকে আমদানি করা হয়। বাংলাদেশে আঙ্গুর ফল এখনো মানুষের প্রধান খাদ্য তালিকায় স্থান পায়নি। কারণ এর অত্যাধিক দাম। বাংলাদেশে আম জাম কাঁঠাল পেয়ারা যতটা সহজলভ্য ততটা সহজলভ্য নয় আঙ্গুর। ফলে এটা এখনো কারো বাড়িতে নিমন্ত্রণে উপহার হিসেবে নিয়ে যাওয়া বা রোগীকে দেখতে যাওয়ার সময় নিয়ে যাওয়া হয়।
আজ এই আর্টিকেলে আঙ্গুর ফলের কিছু উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
আঙ্গুর এর পুষ্টিমান
আঙ্গুর অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি ফল। ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি, চোখের সুস্বাস্থ্য, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি সহ আরো অনেক উপকার করে। এছাড়া আঙ্গুর ভিটামিন সি এর উৎকৃষ্ট উৎস। তাই আজ আমরা জানবো আঙ্গুর এর পুষ্টিমান।
প্রতি ১০০ গ্রাম আঙ্গুর এর পুষ্টিমান—
- শক্তি ২৮৮ কিলো জুল
- শর্করা ১৮.১ গ্রাম
- চিনি ১৫.৪৮ গ্রাম
- খাদ্য আঁশ ০.৯ গ্রাম
- স্নেহ পদার্থ ০.১৬ গ্রাম
- প্রোটিন ০.৭২ গ্রাম
- থায়ামিন ভিটামিন বি১ ০.০৬৯ মিলি গ্রাম
- রিবোফ্লাভিন ভিটামিন বি২ ০.০৭ মিলি গ্রাম
- নায়াসিন বি৩ ০.১৮৮ মিলি গ্রাম
- প্যানটোথেনিক অ্যাসিড বি৫ ০.০৫ মিলি গ্রাম
- ভিটামিন বি৬ ০.০৮৬ মিলি গ্রাম
- ফোলেট বি৯ ২ μg
- কোলিন ৫.৬ মিগ্রা
- ভিটামিন সি ৩.২ মিলি গ্রাম
- ভিটামিন ই ০.১৯ মিলি গ্রাম
- ভিটামিন কে ১৪.৬ μg
- ক্যালসিয়াম ১০ মিলি গ্রাম
- লৌহ ০.৩৬ মিলি গ্রাম
- ম্যাগনেসিয়াম ৭ মিলি গ্রাম
- ম্যাঙ্গানিজ ০.০৭১ মিলি গ্রাম
- ফসফরাস ২০ মিলি গ্রাম
- পটাশিয়াম ১৯১ মিলি গ্রাম
- সোডিয়াম ২ মিলি গ্রাম
- জিংক ০.০৭ মিলি গ্রাম
- পানি ৮১ গ্রাম
*উল্লেখ্য যে— আঙ্গুর ভেদে এবং একেক অঞ্চলের মাটির গুণাগুণ ও আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে আঙ্গুরের পুষ্টিমান। তাই একেক গবেষণায় একেক রকম পুষ্টিমান উল্লেখিত হতে পারে।
আঙ্গুর ফল এর উপকারিতা
আঙ্গুর ফল অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি ফল। যদিও আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ সর্বদা আঙ্গুর ফল খেতে পারে না। কেননা বিদেশ থেকে আমদানি করার ফলে এটার দাম অত্যাধিক থাকে। এছাড়া তা যা আঙ্গুর ফল খাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কারণ, বিদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক প্রয়োগ করে এটাকে তাজা রাখা হয় এবং দেশে আসার পরও ১০ থেকে ১৫ দিন দোকানে পড়ে থাকে। অতএব দেখা যায় যে— এটার সঠিক উপকারিতা আমরা পাই না। তবে তাজা আঙ্গুর ফলে অনেক পুষ্টি।
আরও পড়ুন: ডাবের পানির উপকারিতা ও অপকারিতা
- অনেকের মাথার ত্বক খুবই শুষ্ক। ফলে মাথায় খুব খুশকি হয়। এছাড়া অধিক খুশকির ফলে চুল পড়া আরম্ভ করে। এমতাবস্থায় আঙ্গুর খেলে খুশকি পরা বন্ধ হবে এবং নতুন চুল গজাবে। কেননা আঙ্গুর ফলে রয়েছে ভিটামিন সি। যেটা মাথার ত্বককে পুষ্টি যোগায় এবং খুশকি মুক্ত করে।
- আঙ্গুর ফল ভিটামিন সি এর উৎকৃষ্ট উৎস। এতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি রয়েছে। এছাড়া এর মধ্যে রয়েছে এন্টি অক্সিডেন্ট উপাদান। যা ত্বককে করে ভেতর থেকে প্রাণবন্ত। বয়স বাড়ার সাথে সাথে চেহারায় বালি রেখা দেখা দিতে শুরু করে। কিন্তু ভিটামিন সি এই বালি রেখা অনেকাংশে রোধ করে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খেলে এই বালিরেখা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। বয়সের ছাপ কিছুটা কম দেখা যায়।
- ত্বকের উজ্জ্বলতার জন্য ভিটামিন সি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ত্বকের নানা ধরনের ইনফেকশন থেকে রক্ষা করে ভিটামিন সি। ফুসকুড়ি, এলার্জিজনিত সমস্যা থেকে ভিটামিন সি রক্ষা করে।
- আঙ্গুর ফল খেলে ক্ষতিকর ইউরিক এসিডের মাত্রা কমে যায়। ফলে কিডনি থাকে সুস্থ। কিন্তু এতে থাকা পটাশিয়াম কিডনি রোগীদের জন্য কিছুটা বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে সর্বোপরি আঙ্গুর ফল মানুষের জন্য উপকারী।
- চোখের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় আঙ্গুর ফল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আঙ্গুর পরে থাকা এন্টি অক্সিডেন্ট উপাদান চোখের বিভিন্ন রোগ বালাই থেকে মুক্তি দেয়। এছাড়া আঙ্গুর ফলে আছে ভিটামিন এ। যেটা দৃষ্টিশক্তি প্রখর করতে সাহায্য করে।
- মাথা ব্যথা হলে আঙ্গুর ফল খেলে মাথাব্যথা ভালো হয়ে যায়। কেননা আঙ্গুর ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান। অনেক সময় দেখা যায় পুষ্টির অভাবে মানুষের মাথা ব্যথা করতে পারে। চোখে অন্ধকার দেখতে পারে। এ সকল সমস্যা রোধ করতে আঙ্গুর ফল সাহায্য করে।
- আঙ্গুর ফলে রয়েছে ফাইবার। যেটা খুব সহজে হজম হয়ে যায়। আঙ্গুর ফল মানুষের হজম শক্তি বৃদ্ধি করে। বদহজম দূর করে। তবে এটা বেশি খেলে অনেক সময় পেট ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরিমিত পরিমাণে আঙ্গুর ফল খেলে সমস্যা নেই।
- জেনে নিন: শসার উপকারিতা ও অপকারিতা
- স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করতে আঙ্গুর ফল খুবই কাজে দেয়। এর মধ্যে থাকা পুষ্টি ও খনিজ উপাদান মস্তিষ্কের বিভিন্ন নিউট্রেশনের অভাব দূর করে।
- অ্যাজমা প্রতিরোধ করতে আঙ্গুর ফল খুবই কার্যকরী। ফুসফুস সুস্থ রাখতে আঙ্গুর ফলের মধ্যে থাকা পুষ্টি উপাদান খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। অ্যাজমা রোগীদের আঙ্গুর ফল খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়।
- আঙ্গুল ফলে আছে প্রচুর পরিমাণে খনিজ উপাদান। যেমন কপার, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম— এগুলো হাড় গঠনে সাহায্য করে। মানুষের হাড়কে করে মজবুত।
- আঙ্গুর ফলে ফ্যাট খুবই কম। তাই এটা কোলেস্ট্রল বৃদ্ধি করে না। যাদের রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি তারা এটা খেলেও কোনো সমস্যা হবে না।
- আঙ্গুর ফল হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। কেননা আঙ্গুর ফলের মধ্যে থাকা বিশেষ কিছু উপাদান আছে যার রক্তে চর্বি জমতে দেয় না। ফলে রক্তনালী থাকে রক্ত প্রবাহের জন্য উপযুক্ত। এতে করে হৃদপিণ্ড থাকে সুস্থ।
- আঙ্গুর ফল খেলে ক্ষুধা কম লাগে। তাই যাদের ওজন বেশি তাদের জন্য এটা বেশ উপকারী। এটা খেলে ক্ষুধা কম লাগার কারণে অন্যান্য খাদ্যের চাহিদা কমে যাবে এবং শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমতে থাকবে। এতে করে ওজনও কমবে।
- আঙ্গুর ফল এন্টিঅক্সিডেন্ট উপাদানে ভরপুর। ফলে এটা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এজন্য দেখা যায় ইউরোপের যে সকল দেশে আঙ্গুর চাষ করা হয় সেখানকার বাসিন্দাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। কারণ তারা তাজা আঙ্গুর ফল খায়।
- আঙ্গুর ফল মেলাটোনিন নাম এক ধরনের হরমোন তৈরি করে যা মানুষের সুনিদ্রার জন্য খুবই প্রয়োজন। তাই আঙুল খেলে অনিদ্রা সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
আঙ্গুর এর অপকারিতা
আঙ্গুর ফল যেহেতু আমাদের দেশে চাষ হয় না, তাই আঙ্গুর ফল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বিদেশ থেকে দেশে আনার প্রক্রিয়ায় অনেক সময় লাগে। এই দীর্ঘ সময় এটাকে তাজা রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়। যেগুলো মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কিন্তু আমরা এখানে শুধু তাজা আঙ্গুর ফলের অপকারিতা সম্পর্কে বলব।
আঙ্গুর ফল দিয়ে মদের তৈরি করা হয় এটা সকলেই জানে। কিন্তু আপনারা জানেন কি, এমন অনেক মানুষ আছে যারা আঙ্গুর ফল খেলে তাদের নেশা হওয়া শুরু হয়। এর কারণ হচ্ছে আঙ্গুর ফল অনেক মানুষের পেটে গিয়ে ‘গ্রেপ অ্যালকোহল’ তৈরি করে। হলে মানুষ মদ না খেয়েও মাতালের মতো আচরণ শুরু করে দেয়। মূলত এই ধরনের মানুষেরা কার্বোহাইডেট জাতীয় খাদ্য খেলে এমনটা করে। তা হতে পারে রুটি অথবা অন্যান্য সবজি জাতীয় বস্তু। তবে আঙ্গুর ফল খেলে বেশি মাদকতা হয়।
যাদের কিডনিতে সমস্যা আছে অথবা কিডনি রোগীদের আঙ্গুর ফল খেতে নিরুৎসাহিত করা হয়। কেননা আঙ্গুর ফল কিডনি রোগের ঔষধের প্রভাব কমিয়ে দেয়। এছাড়া আঙ্গুর ফলে রয়েছে পটাশিয়াম। যা কিডনিতে পাথর তৈরি করতে সাহায্য করে এবং যদি কিডনিতে রোগ থাকে তাহলে সেটা আরো বৃদ্ধি করে।
উপসংহার
আঙ্গুর ফল নিঃসন্দেহে খুবই উপকারী এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ একটি ফল। বাংলাদেশে কয়েক জায়গায় এটার ক্ষুদ্র পরিসরের চাষ শুরু হয়েছে। তবে তা খুবই নগণ্য। কেননা বাংলাদেশে যে সকল আঙ্গুর ফল জন্মায় সেগুলো টক হয়। তাই বিদেশ থেকে সকল প্রকারের আঙ্গুর আমদানি করতে হয়। এজন্য দীর্ঘ সময় লাগে। এই দীর্ঘ সময় আঙ্গুর ফল টাটকা রাখার জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। যা মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। পুষ্টির জন্য এই রাসায়নিক যুক্ত আঙ্গুর ফল খাওয়া নিঃসন্দেহে বোকামি। তাই আমাদের উচিত দেশীয় রাসায়নিক মুক্ত ফলগুলো খাওয়া। আম কাঁঠাল কলা পেঁপে পেয়ারা ইত্যাদি ফল রয়েছে যেগুলো রাসায়নিক মুক্ত পাওয়া যায়।
এছাড়া আপনাদের জন্য একটি তথ্য শেয়ার করছি। আমরা ছোটবেলায় অনেকে কিসমিস খেতে পছন্দ করতাম এবং এখনো পছন্দ করি। আপনারা জানেন কি এই কিসমিস তৈরি হয় আঙ্গুর থেকে। আঙ্গুর ফল রোদে শুকিয়ে ফেললে এটা কিসমিস হয়ে যায়।
আঙ্গুর এর উপকারিতা এই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ করার জন্য আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ।