হলুদ উপকারিতা ও অপকারিতা 

”হলুদ বাটিছে হলুদ বরণী মেয়ে,

হলুদের পাটা হাসিয়া গড়ায় রাঙা অনুরাগে নেয়ে।

দুই হাতে ধরি কঠিন পুতারে ঘষিছে পাটার ’পরে,

কাচের চুড়ি যে রিনিক-ঝিনিকি নাচিছে খুশীর ভরে।”

কবি জসীমউদ্দীনের কবিতাটিতে বাটাবাটির কত সুন্দর একটি বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু আজকাল কে হলুদ বেটে খায় অথবা ব্যবহার করে?

হলুদ কেউ বাটুক বা না বাটুক, হলুদের ব্যবহার কিন্তু কমে নেই। বরঞ্চ বলা যায় হলুদ ছাড়া বাঙালির রান্না অসম্পূর্ণ। এই হলুদ এতটাই জনপ্রিয় যে— এই বস্তুটি যে রঙের, সেই রঙটাকে এই বস্তুর নামে রাখা হয়েছে। বড় অদ্ভুত নয় বিষয়টা! 

আমাদের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় এই বস্তুটি সম্পর্কে আজকে আমরা জানবো। হলুদ উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে জানতে হলে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন। 

তবে এখানে একটি কথা উল্লেখ্য যে হলুদ দুই অবস্থায় ব্যবহৃত হয়। একটি হলো এর কাঁচা থাকা অবস্থায়। দ্বিতীয়টি এটা শুকিয়ে গেলে তারপর। 

রান্নায় শুকনো হলুদটাই ব্যবহৃত হয়। তবে কাঁচা হলুদ কোনো অংশে কম নয়। এটাও নানান ধরনের রূপচর্চা ও চিকিৎসা কাজের ব্যবহৃত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।

হলুদ উপকারিতা 

“আমরা এখানে কাঁচা হলুদের উপকারিতা ও এর নানানবিধ ব্যবহার উল্লেখ্য করেছি। কিন্তু কাঁচা হলুদ আপনি কীভাবে ব্যবহার করবেন? আপনি কাঁচা হলুদের চা তৈরি করে এটা পান করতে পারেন। এটা পান করার ফলে যে সকল উপকারিতা পাবেন তা নিম্নে উল্লেখ করা হচ্ছে।”

কাঁচা হলুদ চা কীভাবে বানাবেন: হলুদ আদা গাছের মতোই মাটির নিচে হয় এবং এটা হুবহু আদার মতো দেখতে লাগে। শুধু ভেতরের অংশ হয় হলুদ রঙের এবং শুকিয়ে গেলে শক্ত হয়ে যায়। এই কাঁচা হলুদ দিয়ে আপনারা খুব সহজেই এর চা তৈরি করতে পারেন যা দেহের জন্য খুবই উপকারী।

আরও পড়ুন: সাবুদানা খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা

প্রথমে দুই টেবিল চামচ কাঁচা হলুদ কুচি নেবেন। এরপর আধা লিটার পানিতে এটা দিয়ে অল্প আঁচে সিদ্ধ করবেন। চাইলে আপনি এতে দুটো তুলসী পাতাও দিতে পারেন। ভালোভাবে হলুদের নির্যাস পানির সাথে মিশে গেলে সেটা ছেকে পান করতে পারেন। একটু স্বাদের জন্য এতে লেবুর রস অথবা মধু ব্যবহার করতে পারেন। 

কাঁচা হলুদের চা খাওয়ার উপকারিতা

  • কাঁচা হলুদ রক্তের শর্করার পরিমাণ ঠিক রাখে। রক্তে শর্করা বেশি হলে ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ক্ষতিকর। তাই ডায়াবেটিস রোগীর জন্য কাঁচা হলুদ একটি প্রাকৃতিক ইন্সুলিন।
  • কাঁচা হলুদ হজম শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। কাঁচা হলুদের চা খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
  • সাধারণত আয়রনের অভাবে রক্তশূন্যতা দেখা যায়। কাঁচা হলুদে অনেক আয়রন রয়েছে। যা রক্তের লৌহ কণিকা বৃদ্ধি করে।
  • আমাদের শরীরে কিছু খারাপ কোলেস্টেরল রয়েছে যেগুলো হার্টের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এই সকল কোলেস্ট্রল রক্তনালীতে রক্ত প্রবাহে বাধা প্রদান করে। কাঁচা হলুদ এই সকল কোলেস্ট্রল রক্তনালী থেকে অপসারণ করে হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখে।
  • একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে— কাঁচা হলুদ মানব দেহের কোষ সুস্থ রাখে। ফলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়।

হলুদের উপকারিতা

হলুদের উপকারিতা
“এবার আমরা জানবো গুঁড়া হলুদ বা শুকনো হলুদ খাওয়া এবং এর বাহ্যিক ব্যবহারে কী কী উপকারিতা পাওয়া যায়। হলুদ আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে একটি ঔষধ হিসেবে পরিগণিত হয়। কিন্তু আমরা এর ভেষজ গুণাগুণ সম্পর্কে অবগত না থাকার কারণে এলোপ্যাথি ওষুধের উপর নির্ভরশীল হয়ে গেছি। ফলে আমাদের শরীরে এ সকল কেমিক্যাল যুক্ত ওষুধের নেতিবাচক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে।”
  • হলুদ স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে ও অন্ত্রের ক্যান্সার নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
  • শিশুদের লিউকেমিয়া রোগের ঝুঁকি কমাতে হলুদ সাহায্য করে।
  • হলুদের মধ্যে ব্যথা দূর করার উপাদান রয়েছে। এটা বাতের ব্যথা কম করে।
  • হলুদের মধ্যে আছে একটি বিশেষ গুণ— যা বিভিন্ন ধরনের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কম করতে সাহায্য করে।
  • অগ্নাশয়ের ক্যান্সার দূর করতে হলুদ কাজে লাগে।
  • টিউমার রোধে হলুদ খুবই কার্যকরী এবং হলুদ রক্তের দূষণ কমায়।
  • চর্বি হজম করার জন্য হলুদ খুবই সহায়ক। ফলে বদহজম থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়।
  • চর্ম রোগের জন্য হলুদ ব্যবহার হয়ে আছে বহু যুগ ধরে। কাঁচা হলুদ কাঁচা দুধের সাথে মিশিয়ে শরীরে ভালোভাবে মালিশ করলে এলার্জি কমে যায়।
  • কাঁচা হলুদ হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক এন্টিসেপ্টিক। কোথাও কেটে গেলে অথবা পুড়ে গেলে সেই কাটা বা পোড়া জায়গায় কাঁচা হলুদ বাটা লেপন করলে দ্রুত ক্ষত ভালো হয়। ব্যথা কমে যায় এবং অন্যান্য ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
  • সর্দি-কাশিতে হলুদের ব্যবহার হয়ে থাকে। কুচি করা হলুদের সাথে সামান্য মধু মিশিয়ে সেটা ভালোভাবে চিবিয়ে রসটুকু সেবন করলে সর্দি কাশি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। যদি সেটা সম্ভব না হয় তাহলে গরম দুধের সাথে আধা চামচ হলুদের গুঁড়া মিশিয়ে আন করলে খুব দ্রুত ফলাফল পাওয়া যায়।
  • ত্বকের উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে হলুদ বহু শতাব্দী ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে। এরই উপর ভিত্তি করে বিয়ের আগে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হয়। হলুদ চেহারায় মাখলে চেহারা উজ্জ্বল হয়। এলার্জি জনিত সমস্যা দূর হয়। ব্রণ কমাতে সাহায্য করে।
  • মুখে যদি জ্বালাপোড়া করে তাহলে পানির সাথে হলুদের গুঁড়া মিশ্রণ করে কিছুক্ষণ কুলি করলে আরাম পাওয়া যায়।
  • শ্রমজীবী মানুষেরা রোদে অনেকক্ষণ কাজ করে, ফলে ত্বক পুড়ে যেতে পারে। ফলে অনেক জ্বালা হতে পারে। এমতাবস্থায় টক দইয়ের সাথে কাঁচা বা শুকনো হলুদের গুঁড়ো মিশিয়ে শরীরে মাখলে আরাম পাওয়া যায়।
  • পুরাতন ডায়রিয়া বা পেটে গ্যাস হলে দই এর সাথে কাঁচা হলুদের রস অথবা সামান্য পরিমাণ শুকনো হলুদ গুঁড়ো মিশিয়ে খেলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
  • কৃমি দমনে হলুদ খুবই কার্যকরী। কাঁচা হলুদের রস নিয়মিত সেবন করলে কৃমি দূর হয়। এছাড়া পেটের জ্বালা যন্ত্রণা থাকলেও সেটা ভালো হয়ে যায়।
  • হামজ্বর হলে কাঁচা হলুদের রসের সাথে করোলার রস ও সাথে সামান্য পরিমাণ মধু মিশিয়ে সেবন করলে জ্বর দূর হয়।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য ও বদ হজমের জন্য টক দইয়ের সাথে হলুদের গুঁড়ো মিশিয়ে খেলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
  • অতিরিক্ত সর্দির কারণে অনেক সময় নাকে ক্ষত সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় কাঁচা হলুদের রস খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
  • গলা ভেঙে যাওয়া অর্থাৎ স্বরভঙ্গ হলে গরম পানিতে হলুদ, আদা, লং সিদ্ধ করে তাতে সামান্য পরিমাণ মধু মিশিয়ে পান করলে খুব দ্রুত কণ্ঠ ঠিক হয়ে যায়।
  • গ্রামাঞ্চলে যারা কৃষি ক্ষেতে কাজ করে তাদের প্রায় সময় জোঁকের আক্রমণের শিকার হতে হয়। জোঁক যেখান থেকে রক্ত শোষণ করে সেখানে একটি ক্ষত তৈরি হয় এবং অনবরত রক্ত ঝরতে থাকে। রক্ত বন্ধের জন্য হলুদ বাটা সেখানে প্রয়োগ করতে হবে।
  • হলুদ একটি অ্যান্টিসেপটিক ও এন্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদানের পূর্ণ ভেষজ। যাদের মুখে ব্রণ হয় তারা কাঁচা হলুদ বা শুকনো হলুদের গুঁড়ো, মুলতানি মাটি, চন্দন গুঁড়ো, সামান্য বেসন ও কয়েক ফোটা লেবুর রস দিয়ে একটি পেস্ট বানিয়ে মুখে মাখতে হবে। ১৫ মিনিট রাখার পর মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে। এভাবে সাপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন ব্যবহার করলে খুব দ্রুত ব্রণ দূর হবে, ব্রণের ক্ষতস্থান খুব দ্রুত শুকিয়ে যাবে এবং তক হবে উজ্জ্বল।
  • চোখের নিচের কালো দাগ দূর করতে হলে টক দই, লেবুর রস, হলুদের গুঁড়ো, টমেটোর রস, শসার রস একত্রে মিশিয়ে চোখের নিচে একদিন পরপর ব্যবহার করতে হবে। এতে করে খুব দ্রুত কালো দাগ দূর হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে ঘুম যেন পর্যাপ্ত হয়। নচেৎ কালো দাগ রয়েই যাবে। 
  • চেহারার বালি রেখা দূর করার জন্য ভাতের মাড়ের সাথে লেবুর রস, হলুদের গুঁড়ো, বেসন মিশ্রিত করে এটা প্রতিদিন ব্যবহার করতে হবে। কয়েক সপ্তাহ ব্যবহার করলে দেখা যাবে ত্বক হয়েছে উজ্জ্বল এবং টানটান।

“মোটকথা— হলুদ মানব জীবনে অনেক কাজে লাগে। এটা সঠিক ব্যবহার করতে পারলে আমাদের জন্য অনেক উপকার বয়ে আনবে। তাই প্রত্যেকের উচিত বাড়ির আঙিনায় অথবা বারান্দায় টবে দুই একটি হলুদ গাছ লাগানো।

হলুদ চাষ করা অথবা বাড়ির আঙিনায় হলুদ গাছ রোপন করা অতটা কঠিন কিছু নয়। আদা গাছের মতোই হলুদ গাছ রোপন করা খুব সহজ। কাঁচা হলুদের শিকড় এনে মাটিতে রোপন করলেই সেটা থেকে গাছ গজাতে শুরু করে। এটা ছায়াতেও ভালো জন্মায়। এটা ধীর গতির ফসল তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করলে সেটা পদ্ধতি ভিন্ন। শহরাঞ্চলে জায়গার অভাব অনেক। তাই সেখানে টবের মধ্যে কিছু ভেষজ গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ রোপন করলে বিপদে কাজে লাগে।”

হলুদ অপকারিতা 

হলুদের অসংখ্য গুণ রয়েছে— যেগুলো আমরা এতক্ষণ জানলাম। কিন্তু কোনো জিনিস অতিরিক্ত ভালো না। হলুদ অতিরিক্ত ব্যবহার করলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। 

  • হলুদ বেশি পরিমাণে খেলে লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। 
  • পেটে জ্বালাপোড়া হতে পারে হলুদ বেশি খেলে। 
  • হলুদ রক্তের লৌহ কণিকা উৎপাদনের বাধা প্রদান করে। তবে সামান্য পরিমাণ খেলে সমস্যা নেই।
  • অনেক সময় হলুদ দেহের বাহ্যিক অংশে বেশি ব্যবহারের ফলে মাথা ব্যথা হতে পারে। 

কতটুকু হলুদ খাওয়া উচিত: স্বাভাবিক তরকারিতে অত বেশি পরিমাণে হলুদ দেওয়া উচিত না। যতটা পারা যায় কম হলুদ দিয়ে তরকারি রান্না করতে হবে। বাহ্যিক রোগ অথবা ক্ষতে হলুদ ব্যবহার করলে তেমন একটা সমস্যা হবে না। কিন্তু হলুদ বেশি পরিমাণে খেলে তা ক্ষতিকর হবে মানব দেহের জন্য।

About Juyel Ahmed Liton

সুপ্রিয় “প্রোবাংলা” কমিউনিটি, ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি আকর্ষণ ছিলো এবং হয়তো সেই আকর্ষণটা অন্য দশ জনের থেকে একটু বেশি। ওয়েবসাইট, টাইপিং, আর্টিকেল লেখাসহ টেকনোলজি সবই আমার প্রিয়। জীবনে টেকনোলজি আমাকে যতটা ইম্প্রেস করেছে ততোটা অন্যকিছু কখনো করতে পারেনি। আর এই প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ থেকেই লেখালেখির শুরু.....

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *