একতরফা অসমবয়সী প্রেম: বহুদিন হলো, প্রেমের অধ্যায় চুকিয়ে বহু দূর এসে পড়েছি। মসৃণ পথ শেষ হয়ে গেছে। এখন জীবন চলছে কণ্টকময় সড়কে। সন্ধ্যাও নেমে পড়েছে। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে আছে। হতাশার ঘোর কালো আঁধার আমাকে গ্রাস করতে চারদিকে ঘিরে ধরেছে। কিন্তু জীবন-প্রদীপ এখনো নিভু নিভু করে জ্বলছে। সেই আলোতেই আমি চলছি অনন্ত-অসীম, করুনাময় সত্ত্বার দিকে।
সেই ছোট্ট থাকতে, যেদিন লতা আপুর সাথে একই ছাতার নিচে ঝড়ো বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি ফিরছিলাম। তখন দেখেছিলাম লতা আপুর পায়ের রূপার নুপুর। যা লতা আপু কদম ফেলার তালে তালে রুনু-ঝুনু করে বাজতে ছিলো।
লতা আপুর উন্মুক্ত কেশরাজি বাতাসে যখন ঢেউ খেলছিল, সেই ঢেউয়ের সৌন্দর্য সমুদ্রের ঊর্মিমালাকেও ঈর্ষান্বিত করেছিলো।তখন আমি লতা আপুর এতটা কাছে ঘেঁষে পথ হাঁটছিলাম, যেমনটা বৃক্ষের সাথে ঘেঁষে থাকে লতাগুল্ম।
লতা আপুর বদন থেকে মিষ্টি সৌরভ ভেসে আসছিলো। এমন মাতাল করা সুঘ্রাণ আমি আর কখনো কোথাও পাইনি।
জীবনে প্রথমবার যখন আমি লজ্জাবতী গাছ দেখেছিলাম, স্পর্শ করার সাথে সাথে লজ্জাবতী গাছের পাতাগুলো বুজে গিয়েছিল। যেন লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। তখন আমি যতটা না অবাক হয়েছি, তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছি এটা ভেবে- লতা আপু তাঁর কৃষ্ণোজ্জ্বল অবাধ্য চুলগুলোকে কীভাবে সামলায়?
তখন রমজান মাসে আম্মু রোজা রাখতে দিতো না। বলতো, ছোটরা তিন বেলা ভাত খেলে তিনটি রোজা হয়ে যায়। তবুও মাঝেমধ্যে আম্মুর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রোজা রাখতাম। দুপুরের দিকে প্রচন্ড পানির তেষ্টা পেত। সেই সময়টাতে লতা আপুর স্নিগ্ধ মুখশ্রী পানে মুগ্ধ নয়নে তাকাতাম; সব তৃষ্ণা কর্পূরের মতো উবে যেত।
আকাশে আমি চাঁদকে বিভিন্ন আকৃতিতে দেখতাম। কখনো দেখতাম সরু কাস্তের মতো। ধীরে ধীরে এটা বৃদ্ধি পেতো এবং একসময় পূর্ণ থালার মতো হয়ে জগৎটাকে আলোকিত করতো। তখন চাঁদের এই বৃদ্ধি পাওয়ার রহস্যের সমাধান আমার ছোট্ট মস্তিষ্ক করতে পারেনি। যদিও এখন ওই রহস্যের জট খুলে গিয়েছে।
কিন্তু লতা আপু্র শরীরে মিষ্টি খুশবু কোথা থেকে এসেছিলো, সেই রহস্যটির মীমাংসা এখনো হয়নি। মীর তাহির আলি রিজভী একটি শের বলেছেন। যা অমর হয়ে থাকবে কিয়ামত অবধি।
“মক্তব-এ-ইশক কা দস্তুর নিরালা দেখা
উসে ছুট্টি না মিলি জিসনে সবক ইয়াদ কিয়া”
“দেখেছি প্রেমের পাঠশালার এক অদ্ভুত প্রথা
যে পড়া মুখস্থ করে, সে আর ছুটি পায় না”
আমিও প্রেমের সকল অধ্যায় পড়ে এসেছি। প্রতিটি ঘটনা আমার মনে আছে। তবুও সবকিছু ছেড়ে দিয়ে আমি আবারো পথ চলছি। কিন্তু প্রেম তো নাছোড়বান্দা। সে কি আমার পিছু ছাড়বে?
আরো পড়ুন: জীবনকে সহজ করে দেয় এমন ৩টি গেজেট
একতরফা অসমবয়সী প্রেম
বহুকাল পেরিয়ে, বহু পথ পাড়ি দিয়ে আজ এখানে এসেছি। তবু স্মৃতি আমাকে ছায়ার মতো পিছু করছে। এখনো মনে পড়ে বুক ধুকধুক করার কারণ। লতা আপু প্রতিদিন সন্ধ্যায় কোচিং থেকে ফিরতেন।
না জানি কতবার, আম্মুকে আমি মসজিদে যাওয়ার কথা বলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। লতা আপুকে দেখার বাসনায় কত মাগরিবের নামাজ সেই পথেই কাজা হতো। তিনি যখন সেই পথ দিয়ে আসতেন, দেখতাম পশ্চিম আকাশ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। শুনেছি, ঈশ্বরপ্রেমের প্রমাণ দিতে মাওলা হুসাইন কারবালার প্রান্তরে যে রক্ত ঝরিয়েছেন- এটা সেই রুধির। যা এখনও সাক্ষী হয়ে আছে সারা জগৎবাসীকে দেখানোর জন্য।
লতা আপুকে দেখা মাত্রই আমার বুক কামারের হাপরের মতো ধুকধুক করা শুরু করতো। লতা আপু কাছে এসে আমার মাথার টুপিতে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতো, “কিরে, এখনও মসজিদে যাসনি কেন?” আমি তখন কীভাবে বলতাম, আমার প্রেমের নামাজ এখানেই আদায় হচ্ছে।
সেই দিন গত হয়ে গেছে বহু আগে। সেই স্মৃতির রঙিন আলো অন্তরের পর্দায় প্রতিফলিত হয়। হাত দিয়ে ধরে রাখতে চাই সেই রঙিন দৃশ্যপটগুলো। কিন্তু আলো কি কখনো ধরে রাখা যায়? কেউ কি সময়কে কখনো ধরে রাখতে পেরেছে? যে চলে যাওয়ার তাকে কি কখনো আটকে রাখা যায়?
প্রেমের শ্রাবণ ধারায় আমার হৃদয় কাদামাটির মতো গলে গিয়েছিল। কিন্তু হারানোর বেদনা, না পাওয়ার কষ্টের উত্তাপে আবারো হৃদয়টাকে ইটের মতো শক্ত করেছি। মাতম করে করে হৃদয়টাকে দুর্গের মতো করে গড়ে তুলেছি। কিন্তু…
কিন্তু বহুদিন পর কে যেন আবার কিন্নর কণ্ঠের তীর নিক্ষেপ করেছে আমার দুর্গবৎ হৃদয়ের প্রচীরে। আবারো প্রেমের বৃষ্টি ঝরতে শুরু করেছে। আবারো হিমালয়ের বরফের মতো গলে যাচ্ছে মন। তাঁর কণ্ঠস্বরের ঝংকারে আবারও আমার বুক কামারের হাপরের মতো ধুক-ধুক করছে।
কিরে ব্যাটা, তোর কী হয়েছে? তুই কি আল্লামা ইকবালের ওই শেরটি পড়িসনি? যেখানে ইকবাল বলেন,
“সিতারো সে আগে জাহান অর ভি হ্যায়
আভি ইশক কে ইমতেহান অর ভি হ্যায়”
“নক্ষত্রলোকের পরেও আরো একটি জগৎ বাকি আছে
এখনও প্রেমের পরীক্ষা আরো বাকি আছে”
তোর এই একতরফা অসম বয়সী প্রেমে আছে দুঃখের ঘূর্ণিঝড়। তুই কি পারবি বাস্তবতার উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে প্রেমের ওই দ্বীপে পৌঁছাতে? তোর কি সেই সাধ্য আছে? তোর আর তাঁর মাঝে রয়েছে বিস্তর তফাৎ। আর্থিক, জগতে আগমনের তারিখ; এতসব পার্থক্যের দরিয়ায় এখনও সাম্যের পুল নির্মাণ হয়নি।
সে থাকে চন্দ্রমুল্লুকের জ্যোৎস্নানগরে। তোর চেয়ে শত-সহস্র ক্রোশ দূরে। সে কি তোর জন্য এই ধুলিময় জমিনে অবতরণ করবে?
হয়তো তুই লতা আপুর মতো তাঁকেও হারাতে চাস না। ভাবছিস তাঁকে হারিয়ে ফেললে তুই আবারও একাকী হয়ে যাবি।
আরে, তোর জন্মের সময় একাকীত্বও তোর সাথে জন্ম নিয়েছিল। জন্মলগ্ন থেকে ছায়ার মতো তোর সাথেই আছে। এটাই তোর পরম আপন। একাকীত্ব তোকে কখনো ছেড়ে যাবে না। তুই চাইলেও এটাকে দূরে সরাতে পারবি না। কেননা ভাগ্যলেখক এটা তোর নসিবে লিখে দিয়েছেন।
এতটা বছর তুই হৃদয়টাকে সামলে রেখেছিস। জগতের রূপ, রঙ প্রতিনিয়ত বদলাতে দেখেছিস। এখনও তুই কি তুই বুঝতে পারিসনি, এই সমাজ-সংসারে প্রেম ভালবাসা মূল্যহীন। অর্থের জোরে সম্পর্ক জোড়া বাঁধে। আর তুই তো পকেটে গ্রামের মাটি নিয়ে ঘুরছিস।
চন্দ্র স্পর্শ করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে হিমালয়ে চড়তে যাসনে। হিমালয়ের চূড়ায় উঠলেও তুই তাঁর নাগাল পাবি না। হয়তো তুই ভাবছিস, তোর উপর তো সে তাঁর কণ্ঠের মিঠা জ্যোৎস্না বর্ষণ করে। তুই তো জানিস না, আসমানে চাঁদ উঠলে জ্যোৎস্না সবার উপরেই বর্ষিত হয়। তুই নিজেকে চকোর পাখি ভেবে সেই জ্যোৎস্না সুধা পান করছিস।
আরে ব্যাটা, তোর জন্য বিশেষ কোনো করুণা তাঁর মাঝে নেই। সে তো উদয় হয় সমুদ্রে তার রূপ দেখার জন্য।
এবার তো একটু থাম। প্রেমের পেছনে ছুটে ছুটে তুই বড্ড ক্লান্ত। একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর। জগতে ঘুমের চেয়ে শান্তির আর কোনো কিছু নেই। ঘুমেই শান্তি। ঘুমেই মঙ্গল।
লেখক: হৃদয় মৃধা
It was an interesting story.